একটু চোখ বুলিয়ে নিন
বিষ
১৯৭১ সালের ঘটনা।
কায়রোর একটি মসজিদ। মসজিদটি বেশী বড়ও নয়, তেমন ছোটও নয়। জুমার জামাত অনুষ্টিত না হলেও পাঞ্জেগানা জামাতে মুসল্লি হয় প্রচুর।
শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এ মসজিদ-এলাকায় বাস করে মধ্যম ও নিম্নবিত্তের মানুষ। ধর্মের প্রতি এখনো তারা বেশ অনুরাগী। আবেগপূর্ণ আকর্ষণীয় কথায় সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তবে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মিসর এসে যেসব নতুন সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন, তাতে এই এলাকার লোকেরাই ভর্তি হয়েছিল বেশী। তার কারণ ছিল দুটি। প্রথমতঃ এটি জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যম। সালাহুদ্দীন আইউবী তার সৈন্যদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন। দ্বিতীয়তঃ জিহাদ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আমল, তা তাদের ভাল করেই জানা ছিল। ইসলামের জন্য জীবন দিতে তারা প্রস্তুত থাকত সর্বক্ষণ। সে যুগে তাদের মত চেতনাসম্পন্ন মর্দে মুমিনের প্রয়োজন ছিল অপরিসীম। সরকারীভাবে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, খৃষ্টজগত ইসলামী দুনিয়ার নাম-চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। বীর বিক্রমে তাদের মোকাবেলা করে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে জিহাদের ময়দানে।
ছয়-সাত মাস হল, অখ্যাত এ মসজিদটির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিক। এই খ্যাতির কারণ নতুন ইমাম, যিনি প্রতিদিন ঈশার নামাযের পর আকর্ষণীয় দরস প্রদান করছেন।
আগের ইমাম তিনদিন আগে মারা গেছেন। তিনি দুঃসহ পেটব্যাথা আর অস্ত্র জ্বালায় ভুগছিলেন। অভিজ্ঞ ডাক্তার-হেকিম কেউ-ই তার এ রোগের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেননি। অবশেষে এ রোগেই তিনি মারা যান। তিনি একজন সাধারণ মৌলভী ছিলেন। শুধু পাঞ্জেগানা জামাতের ইমামতি করতেন। এর অতিরিক্ত কোন যোগ্যতা তার ছিল না।
ইমামের মৃত্যুর ঠিক আগের দিন অচেনা এক মৌলভী এসে হাজির হন মসজিদে। লোকটির গৌরবর্ণ চেহারা। সুঠাম দেই। মুখজোড়া ঘন লম্বা দাড়ি। সঙ্গে আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃতা দুজন মহিলা। সম্পর্কে তার স্ত্রী। দুই স্ত্রী নিয়ে তিনি এতদিন কোন এক ঝুপড়িতে বাস করতেন।
আলাপ-পরিচয়ের পর আগন্তুক অত্র মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বেতন-ভাতার প্রয়োজন নেই। মুসল্লিদের খাতির-সমাদরও তার নিষ্প্রয়োজন। কারো হাদিয়া-নজরানাও গ্রহণ করবেন না। প্রয়োজন শুধু মানসম্পন্ন প্রশস্ত একটি বাসস্থান, যেন তিনি সেখানে দুই স্ত্রীসহ সম্মান ও পর্দার সাথে বাস করতে পারেন।
মুসল্লিরা তার প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে নেয়। তারা মসজিদের সন্নিকটে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়িও তাকে খালি করে দেয়। দুই স্ত্রীকে নিয়ে সেই বাড়িতে এসে উঠেন নতুন ইমাম। স্ত্রী দুজন কালো বোরকায় আবৃতা। হাতে-পায়ে কালো মোটা মোজা। দেহের কোন অংশ পর-পুরুষের চোখে পড়ার জো নেই। এমন পর্দানশীল মহিলা এ যুগে কমই চোখে পড়ে। মুসল্লিরা ঘরের জরুরী আসবাবপত্রের ব্যবস্থাও করে দেয়। বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তাদের মনে নতুন ইমামের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে একজন যোগ্য ইমাম পেয়ে গেছি, এই তাদের বিশ্বাস।
প্রথমবারের মত মিনারে দাঁড়িয়ে আযান দেন নতুন ইমাম। সে কি যাদুমাখা সুরেলা কণ্ঠ! যতদূর পর্যন্ত তার আযানের আওয়াজ পৌঁছে, সর্বত্র যেন নেমে আসে এক স্বর্গীয় নিস্তব্ধতা। গোটা প্রকৃতিকে মাতাল করে তুলছে যেন তার আযানের মধুর আওয়াজ। তার যাদুময় আযানের চুম্বকর্ষণে তারাও মসজিদপানে ছুটে আসে, ইতিপূর্বে যারা নামায পড়ত ঘরে, কিংবা আদৌ নামাযে অভ্যস্থ ছিল না।
প্রথম রাতেই তিনি ঈশার নামাযের পর মসজিদে দন্স প্রদান করেন। পরে ঘোষণা দেন যে, এভাবে প্রতি রাতেই তিনি দর্স প্রদান করবেন। নতুন ইমামের বয়ান শুনে মুসল্লিরা বেজায় খুশি।
ছয়-সাত মাস সময়ে নতুন ইমাম মুসল্লিদেরকে তার নিবেদিতপ্রাণ ভক্তে পরিণত করেন। অনেকে তার মুরীদও হয়ে যায়।