বিচারক - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Bicharok By Rabindranath Tagore)

বিচারক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Bicharok By Rabindranath Tagore)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

পৌষ, ১৩০১

প্রথম পরিচ্ছেদ
অনেক অবস্থান্তরের পর অবশেষে গতযৌবনা ক্ষীরোদা যে পুরুষের আশ্রয় প্রাপ্ত হইয়াছিল সেও যখন তাহাকে
জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করিয়া গেল, তখন অন্নমুষ্টির জন্য দ্বিতীয় আশ্রয় অন্বেষণের চেষ্টা করিতে তাহার
অত্যন্ত ধিককার বোধ হইল।

যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময় । তখন আর উদ্দাম যৌবনের বসন্তচঞ্চলতা শোভা পায় না। ততদিনে সংসারের মাঝখানে আমাদের ঘর বাধা একপ্রকার সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে ; অনেক ভালোমন্দ, অনেক সুখদুঃখ, জীবনের মধ্যে পরিপাক প্রাপ্ত হইয়া অন্তরের মানুষটিকে পরিণত করিয়া তুলিয়াছে ; আমাদের আয়ত্বের অতীত কুহকিনী দুরাশার কম্পনালোক হইতে সমস্ত উদ্ভ্রান্ত বাসনাকে প্রত্যাহরণ করিয়া আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতার গৃহপ্রাচীরমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি ; তখন নূতন প্রণয়ের মুগ্ধদৃষ্টি আর আকর্ষণ করা যায় না, কিন্তু পুরাতন লোকের কাছে মানুষ আরো প্রিয়তর হইয়া উঠে । তখন যৌবনলাবণ্য অল্পে অল্পে বিশীর্ণ হইয়া আসিতে থাকে,
কিন্তু জরাবিহীন অন্তরপ্রকৃতি বহুকালের সহবাসক্রমে মুখে চক্ষে যেন স্ফুটতর রূপে অস্কিত হইয়া যায়, হাসিটি
দৃষ্টিপাতটি কণ্ঠস্বরটি ভিতরকার মানুষটির দ্বারা ওতপ্রোত হইয়া উঠে। যাহা-কিছু পাই নাই তাহার আশা ছাড়িয়া,
যাহারা ত্যাগ করিয়া গিয়াছে তাহাদের জন্য শোক সমাপ্ত করিয়া, যাহারা বঞ্চনা করিয়াছে তাহাদিশ্গকে ক্ষমা করিয়া- যাহারাছে আসিয়াছে, ভালোবাসিয়াছে, সংসারের সমস্ত ঝড়ঝঞ্ছা শোকতাপ বিচ্ছেদের মধ্যে যে কয়টি প্রাণী নিকটে অবশিষ্ট রহিয়াছে তাহাদিগকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া সুনিশ্চিত সুপরীক্ষিত চিরপরিচিতগণের প্রীতিপরিবেষ্টনের মধ্যে নিরাপদ নীড় রচনা করিয়া তাহারই মধ্যে সমস্ত চেষ্টার অবসান এবং সমস্ত আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়। যৌবনের সেই স্নিগ্ধ সায়াহ্নে জীবনের সেই শান্তিপর্বে ও যাহাকে নূতন সঞ্চয়, নূতন পরিচয়, নূতন বন্ধনের বৃথা আশ্বাসে নূতন চেষ্টায় ধাবিত হইতে হয়– তখনো যাহার বিশ্রামের জন্য শষ্যা রচিত হয় নাই, যাহার গৃহপ্রত্যাবর্তনের জন্য সন্ধ্যাদীপ প্রজ্জলিত হয় নাই, সংসারে তাহার মতো শোচনীয় আর কেহ নাই।

ক্ষীরোদা তাহার যৌবনের প্রান্তসীমায় যেদিন প্রাতঃকালে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল তাহার প্রণয়ী পূর্ব রাত্রে তাহার
সমস্ত অলংকার ও অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, বাড়িভাড়া দিবে এমন সঞ্চয় নাই– তিন বৎসরের
শিশুপুত্রটিকে দুধ আনিয়া খাওয়াইবে এমন সংগতি নাই– যখন সে ভাবিয়া দেখিল, তাহার জীবনের আট ত্রিশ
বৎসরে সে একটিও লোককেও আপনার করিতে পারে নাই, একটি ঘরের প্রান্তেও বাচিবার ও মরিবার অধিকার
প্রাপ্ত হয় নাই ; যখন তাহার মনে পড়িল, আবার আজ অশ্রজল মুছিয়া দুই চক্ষে অঞ্জন পরিতে হইবে, অধরে ও
কপোলে অলক্তরাগ চিত্রিত করিতে হইবে, জীর্ণ যৌবনকে বিচিত্র ছলনায় আচ্ছন্ন করিয়া হাস্যমুখে অসীম ধৈর্য
সহকারে নূতন হৃদয় হরণের জন্য নূতন মায়াপাশ বিস্তার করিতে হইবে ; তখন সে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ভূমিতে
লুটাইয়া বারংবার কঠিন মেঝের উপর মাথা খুঁড়িতে লাগিল– সমস্ত দিন অনাহারে মুমূর্ষুর মতো পড়িয়া রহিল।
সন্ধ্যা হইয়া আসিল। দীপহীন গৃহকোণে অন্ধকার ঘনীভূত হইতে লাগিল। দৈবক্রমে একজন পুরাতন প্রণয়ী আসিয়া
‘ক্ষীরো ক্ষীরো’ শব্দে দ্বারে আঘাত করিতে লাগিল । ক্ষীরোদা অকস্মাৎ দ্বার খুলিয়া ঝাঁটাহস্তে বাঘিনীর মতো গর্জন
করিয়া ছুটিয়া আসিল ; রসপিপাসু যুবকটি অনতিবিলম্বে পলায়নের পথ অবলম্বন করিল।…

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top