একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
বলরামপুর গ্রামের রথতলায় চাষাভূষাদের একটা বৈঠক হইয়া গেল। নিকটবর্তী রেলওয়ে লাইনের কুলি গ্যাং রবিবারের ছুটির ফাকে যোগদান করিয়া সভার
মর্যাদা বৃদ্ধি করিল এবং কলিকাতা হইতে জনকয়েক নামকরা বক্তা আসিয়া আধুনিক কালের অসাম্য ও অমৈত্রীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিয়া জ্বালাময়ী বক্তৃতা
দান করিলেন। অসংখ্য প্রস্তাব গৃহীত হইল ও পরে শোভাযাত্রায় বন্দেমাতরম্ ধ্বনিসহযোগে গ্রাম পরিক্রমণপূর্বক সেদিনের মত সম্মিলনীর কার্য সমাধা হইল।
বলরামপুর সমৃদ্ধ গ্রাম । ছোট-বট অনেকগুলি তালুকদার ও সম্পন্ন গৃহস্থের বাস। একপ্রান্তে মুসলমান কৃষকপল্লী ও তাহারই অদূরে ঘর-কয়েক বাগদী ও
দুলেদের বসতি ভাগীরথীর একটি শাখা বহুকাল পূর্বে মজিয়া অর্ধবৃত্তাকারে ক্রোশেক বিস্তৃত বিলের সৃষ্টি করিয়াছে, ইহারই তীরে তাহাদের কুটির। এই গ্রামের
সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী ব্যক্তি যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যায় । জমিজমা তালুক-তেজারতি প্রভৃতিতে তাহার সম্পত্তি ও সম্পদ প্রচুর বলিলে অতিশয়োক্তি হয় না। তাহার
সুবৃহৎ অট্টালিকার সম্মুখের পথে এই শোভাযাত্রা যখন রক্তপতাকায় লিখিত নানাবিধ “বাণী” ও বিপুল চীৎকারে কৃষক-মজুরের জয়-জয়কার হাকিয়া অতিক্রম
করিতেছিল, তখন দ্বিতলের বারান্দায় দীড়াইয়া এক দীর্ঘাকৃতি বলিষ্ট-গঠন যুবক নীচের সমস্ত দৃশ্য নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিতেছিল। অকন্মাৎ তাহার প্রতি দৃষ্টি
পড়ায় বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্বেলিত কোলাহল যেন একমুহূর্তে নিবিয়া গেল। পুরোবতীঁ নেতৃস্থানীয় জন দুই-তিন ব্যক্তি চমকিয়া ইতস্ততঃ চাহিয়া বহু লোকের দৃষ্টি
অনুসরণ করিয়া উপরের দিকে মুখ তুলিতেই তিনি থামের আড়ালে ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইয়া গেলেন। তাহারা জিজ্ঞাসা করিলেন, কে?
অনেকেই চাপা মৃদুকণ্ঠে উত্তর দিল, বিপ্রাদাসবাবু!
কে বিপ্রদাসঃ গায়ের জমিদার বুঝি?
কে একজন কহিল, হাঁ।
নেতারা শহরের লোক, কাহাকেও বড়-একটা গ্রাহ্য করেন না; উপেক্ষাভরে কহিলেন, ওঃ এই! এবং পরক্ষণেই উচ্চ-চীৎকারে মাথার উপরে হাত ঘুরাইয়া
সমস্বরে হাকিলেন, বল “ভারত মাতার জয়!” বল, ‘কৃষাণ-মজুরের জয়! বল, বন্দেমাতরমৃ!’
বিশেষ ফল হইল না। অনেকেই চুপ করিয়া রহিল, অথবা মনে মনে বলিল এবং যে দুই-চারিজন সাড়া দিল তাহাদেরও ক্ষীণকণ্ঠ বেশী উর্ধ্বে উঠিল
না-বিপ্রদাসের বারান্দা ডিাইয়া তাহার কানে পৌঁছিল কি না বুঝা গেল না। নেতারা নিজেদের অপমানিত জ্ঞান করিলেন, বিরক্ত হইয়া কহিলেন, এই একটা সামান্য গ্রাম্য জমিদার তাকেই এত ভয়! ওরাই ত আমাদের পরম শক্র,_আমাদের গায়ের রক্ত অহরহ শুষে খাচ্চে। আমাদের আসল অভিযান ত ওদেরই
বিরুদ্ধে! ওরা যে-_
প্রদীপ্ত বাগ্িতায় সহসা বাধা পড়িল। বহু শাণিত শর তখনও তাহাদের তৃণে সঞ্চিত ছিল, কিন্তু প্রয়োগ করায় বিঘ্ন ঘটিল। কে একজন ভিড়ের মধ্য হইতে
আস্তে বলিল, ওর দাদা!