https://www.freepdfhouse.com/wp-content/uploads/2024/02/Joy-Porajoy-by-Rabindranath-Tagore.pdf

জয়পরাজয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Joy Porajoy by Rabindranath Tagore)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

রাজকন্যার নাম অপরাজিতা । উদয়নারায়ণের সভাকবি শেখর তাহাকে কখনো চক্ষেও দেখেন নাই। কিন্তু যেদিন কোনো নূতন কাব্য রচনা করিয়া সভাতলে বসিয়া রাজাকে শুনাইতেন, সেদিন কণ্ঠস্বর ঠিক এতটা উচ্চ করিয়া পড়িতেন যাহাতে তাহা সেই সমুচ্চ গৃহের উপরিতলের বাতায়নবর্তিনী অদৃশ্য শ্রোত্রীগণের কর্ণপথে প্রবেশ করিতে পারে । যেন তিনি কোনো-এক অগম্য নক্ষত্রলোকের উদ্দেশে আপনার সংগীতোচ্ছ্বাস প্রেরণ করিতেন যেখানে জ্যোতিষ্ক-মণ্ডলীর মধ্যে তাহার জীবনের একটি অপরিচিত শুভগ্রহ অদৃশ্য মহিমায় বিরাজ করিতেছেন ।

কখনো ছায়ার মতন দেখিতে পাইতেন, কখনো নূপুরশিঞ্জনের মতন শুনা যাইত ; বসিয়া বসিয়া মনে মনে ভাবিতেন, সে কেমন দুইখানি চরণ যাহাতে সেই সোনার নূপুর বাধা থাকিয়া তালে তালে গান গাহিতেছে। সেই দুইখানি রক্তিম শুভ্র কোমল চরণতল প্রতি পদক্ষেপে কী সৌভাগ্য কী অনুগ্রহ কী করুণার মতো করিয়া পৃথিবীকে স্পর্শ করে। মনের মধ্যে সেই চরণদুটি প্রতিষ্ঠা করিয়া কবি অবসরকালে সেইখানে আসিয়া লুটাইয়া পড়িত এবং সেই নূপুরশিঞ্জনের সুরে আপনার গান বাধিত। কিন্তু যে-ছায়া দেখিয়াছিল, যে-নূপুর শুনিয়াছিল, সে কাহার ছায়া, কাহার নূপুর, এমন তর্ক এমন
সংশয় তাহার ভক্তহদয়ে কখনো উদয় হয় নাই।

রাজকন্যার দাসী মঞ্জরী যখন ঘাটে যাইত, শেখরের ঘরের সম্মুখ দিয়া তাহার পথ ছিল । আসিতে যাইতে কবির সঙ্গে তাহার দুটা কথা না হইয়া যাইত না। তেমন নির্জন দেখিলে সে সকালে সন্ধ্যায় শেখরের ঘরের মধ্যে গিয়াও বসিত | যতবার সে ঘাটে যাইত ততবার যে তাহার আবশ্যক ছিল, এমনও বোধ হইত না, যদিবা আবশ্যক ছিল এমন হয় কিন্তু ঘাটে যাইবার সময় উহারই মধ্যে একটু বিশেষ যত করিয়া একটা রঙিন কাপড় এবং কানে দুইটা আম্রমুকুল পরিবার কোনো উচিত কারণ পাওয়া যাইত না।

লোকে হাসাহাসি কানাকানি করিত । লোকের কোনো অপরাধ ছিল না। মঞ্জরীকে দেখিলে শেখর বিশেষ আনন্দলাভ করিতেন । তাহা গোপন করিতেও তাহার তেমন প্রয়াস ছিল না।

তাহার নাম ছিল মঞ্জরী ; বিবেচনা করিয়া দেখিলে সাধারণ লোকের পক্ষে সেই নামই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু শেখর আবার আরো একটু কবিতা করিয়া তাহাকে বসন্তমঞ্জরী বলিতেন। লোকে শুনিয়া বলিত, “আ সর্বনাশ”

আবার কবির বসন্ত বর্ণনার মধ্যে “মঞ্জুলবঞ্জুলমঞ্জরী” এমনতরো অনুপ্রাসও মাঝে মাঝে পাওয়া যাইত । এমন-কি, জনরব রাজার কানেও উঠিয়াছিল।

রাজা তাহার কবির এইরূপ রসাধিক্যের পরিচয় পাইয়া বড়োই আমোদবোধ করিতেন– তাহা লইয়া কৌতুক করিতেন, শেখরও তাহাতে যোগ দিতেন।

রাজা হাসিয়া প্রশ্ন করিতেন, “ভ্রমর কি কেবল বসন্তের রাজসভায় জ্ঞান গায়–“

কবি উত্তর দিতেন, “না, পুষস্পমঞ্জরীর মধুও খাইয়া থাকে।”

এমনি করিয়া সকলেই হাসিত, আমোদ করিত ; বোধ করি অন্তঃপুরে রাজকন্যা অপরাজিতাও মঞ্জরীকে লইয়া মাঝে মাঝে উপহাস করিয়া থাকিবেন। মঞ্জরী তাহাতে অসন্তুষ্ট হইত না।

এমনি করিয়া সত্যে মিথ্যায় মিশাইয়া মানুষের জীবন একরকম করিয়া কাটিয়া যায়– খানিকটা বিধাতা গড়েন, খানিকটা আপনি গড়ে, খানিকটা পাঁচজনে গড়িয়া দেয় ; জীবনটা একটা পাঁচমিশালি রকমের জোড়াতাড়া– প্রকৃত এবং অপ্রকৃত, কাল্পনিক এবং বাস্তবিক ।

কেবল কবি যে-গানগুলি গাহিতেন তাহাই সত্য এবং সম্পূর্ণ। গানের বিষয় সেই রাধা এবং কৃষ্ণ–সেই চিরন্তন নর এবং চিরন্তন নারী, সেই অনাদি দুঃখ এবং অনন্ত সুখ । সেই গানেই তাঁহার যথার্থ নিজের কথা ছিল– এবং সেই গানের যাথার্থ্য অমরাপুরের রাজা হইতে দীনদুঃখী প্রজা পর্যন্ত সকলেই আপনার হৃদয়ে হৃদয়ে পরীক্ষা করিয়াছিল। তাহার গান সকলেরই মুখে । জ্যোৎস্না উঠিলেই, একটু দক্ষিনা বাতাসের আভাস দিলেই, অমনি দেশের চতুর্দিকে কত কানন, কত পথ, কত নৌকা, কত বাতায়ন, কর প্রাঙ্গন হইতে তাহার রচিত গান উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিত– তাহার খ্যাতির আর সীমা ছিল না।

এইভাবে অনেকদিন কাটিয়া গেল। কবি কবিতা লিখিতেন, রাজা শুনিতেন, রাজসভার লোক বাহবা দিত, মঞ্জরী ঘাটে আসিত– এবং অন্তঃপুরের বাতায়ন হইতে কখনো কখনো একটা ছায়া পড়িত, কখনো কখনো একটা নূপুর শুনা যাইত।

এমন সময়ে দক্ষিণাত্য হইতে এক দিগ্বিজয়ী কবি শার্দুল বিক্রীড়িত ছন্দে রাজার স্বগান করিয়া রাজসভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি স্বদেশ হইতে বাহির হইয়া পথিমধ্যে সমস্ত রাজকবিদিগকে পরাস্ত করিয়া অবশেষে অমরাপুরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

রাজা পরম সমাদরের সহিত কহিলেন, “এহি, এহি

কবি পুন্ডরীক দম্ভভরে কহিলেন, “যুদ্ধং দেহি ।”

রাজার মান রাখিতে হইবে, যুদ্ধ দিতে হইবে, কিন্তু কাব্যযুদ্ধ যে কিরূপ হইতে পারে শেখরের সে সম্বন্ধে ভালোরূপ ধারণা ছিল না। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত ও শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। রাত্রে নিদ্রা হইল না। যশস্বী পুন্ডরীকের দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ, সুতীক্ষ্ণ বক্র নাসা এবং দর্পোদ্ধত উন্নত মস্তক দিগ্বিদিকে অঙ্কিত দেখিতে লাগিলেন।

প্রাতঃকালে কম্পিতহদয় কবি রণক্ষেত্রে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। প্রত্যুষ হইতে সভাতল লোকে পরিপূর্ণ হইয়া গেছে, কলরবের সীমা নাই ; নগরে আর-সমস্ত কাজকর্ম একেবারে বন্ধ ।

কবি শেখর বহুকষ্টে মুখে সহাস্য প্রফুল্পতার আয়োজন করিয়া প্রতিদ্বন্দ্রী কবি পুন্ডরীককে নমস্কার করিলেন ; পুন্ডরীক প্রচণ্ড অবহেলাভরে নিতান্ত ইঙ্গিতমাত্রে নমস্কার ফিরাইয়া দিলেন এবং নিজের অনুবর্তী ভক্তবৃন্দের দিকে চাহিয়া হাসিলেন।

শেখর একবার অন্তঃপুরের বাতায়নের দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন– বুঝিতে পারিলেন, সেখান হইতে আজ শত শত কৌতুহলপূর্ণ কৃষ্ণতারকার ব্যগ্রদৃষ্টি এই জনতার উপরে অজস্র নিপতিত হইতেছে । একবার একাগ্রভাবে চিত্তকে সেই উর্ধলোকে উৎক্ষিপ্ত করিয়া আপনার জয়লক্মীকে বন্দনা করিয়া আসিলেন, মনে মনে কহিলেন, “আমার যদি আজ জয় হয় তবে, হে দেবি, হে অপরাজিতা, তাহাতে তোমারই নামের সার্থকতা হইবে।

তুরী ভেরী বাজিয়া উঠিল। জয়ধ্বনি করিয়া সমাগত সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। শুক্লবসন রাজা উদয়নারায়ণ শরত্প্রভাতের শুভ্র মেঘরাশির ন্যায় ধীরগমনে সভায় প্রবেশ করিলেন এবং সিংহাসনে উঠিয়া বসিলেন।

পুন্ড্ররীক উঠিয়া সিংহাসনের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইলেন। বৃহৎ সভা স্তব্দ হইয়া গেল।

বক্ষ বিম্ফারিত করিয়া গ্রীবা ঈষৎ উর্ধে হেলাইয়া বিরাটমূর্তি পুন্ডরীক গম্ভীরস্বরে উদয়নারায়ণের স্তব…

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top