একটু চোখ বুলিয়ে নিন
ঈমানের ঝলক
১৮২৬ এর পহেলা ডিসেম্বর। সূর্যাস্ত হয়নি এখনো। তবে মোগল সালতানাতের অমিত তেজী সূর্য সেই কবে থেকে অস্তাচলের পথে যাত্রা শুরু। করেছে। সালতানাতের রক্ষাকবচ হিসেবে যে কেল্লাগুলো মোগলীয় হস্তে নির্মিত হয়েছিলো সেগুলো এখন তাদের কবরগুলোর মতো উদাস-নীরব দর্শক হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি কেল্লা হলো কেল্লায়ে লাহোর। যাকে বলা হয় শাহী কেল্লা। এই কেল্লা এখন শিখদের কজায় রয়েছে।
এই কেল্লার প্রধান অর্থাৎ কেল্লাদার উধাম শিং প্রতিদিনের মতো সান্ধ্য ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। সঙ্গে তার দুই মুহাফিজ। এক শিখকে এদিকে তখন দৌড়ে আসতে দেখা গেলো। মুহাফিজ দুজন এগিয়ে গিয়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
ব্যাপার কি? দৌড়ে আসছো কেন?– মুহাফিজরা জিজ্ঞেস করলো।
আমি কেল্লার কাসেদ– শিখ বললো।
আসতে দাও ওকেউধাম শিং হুকুম দিলেন–এদিকে এসো হে! কি হয়েছে বলো।
একজন মুসলমানকে পাকড়াও করা হয়েছে মহারাজ! কাসেদ এগিয়ে এসে বললো- সে নাকি ইসলামী ফৌজের কাসেদ। মহারাজার জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছে। আপনার এজাযত ছাড়া তো ওকে মহারাজার সামনে নেয়া যাবে না।
ইসলামী ফৌজ? উধাম শিং নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো-কিসের ইসলামী ফৌজ? … উহ … এ মনে হয় পেশাওয়ারের পাঠান খান্দানের কাসেদ। দাম্ভিক কণ্ঠে বললেন এবার। এ ধরনের কাসেদকে গ্রেফতার করার কি প্রয়োজন ছিলো? সন্ধির প্রস্তাব মনে হয় সে নিয়ে এসেছে। এমন কমজোর লোকদের কাসেদকে ভয় কিসের? … যাও আমি আসছি। ওকেও নিয়ে এসো।
কেল্লার এক জায়গায় কমপক্ষে বিশ বাইশজন শিখ খোলা তলোয়ার নিয়ে এক মুসলিম যুবককে ঘিরে রেখেছে। কেল্লার প্রধান উধাম শিংকে দেখে তারা ঘেরাও হালকা করে দিলো। উধাম শিং দেখলেন, বিশ বাইশ বছরের গৌর বর্ণের সুদর্শন এক যুবক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার তলোয়ারটি তার কোষাবদ্ধ রয়েছে। উধাম শিং এর চেহারা থমথমে হয়ে উঠলো। তিনি সহকারী কেল্লাদার কাহেন শিং এর দিকে রাগত চোখে তাকালেন।
মহারাজ! কাহেন শিং কেলাদারের রাগত দৃষ্টির প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললল– এ মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে। কিন্তু ওর তলোয়ার আমাদের কাছে হাওলা করছে না।
কি নাম তোমার? উধাম শিং আগত যুবককে জিজ্ঞেস করলো- কোত্থেকে এসেছো?
আমার নাম হিম্মত খান। আমি আমাদের সালারে আলা সায়্যিদ আহমদের পয়গাম এনেছি মহারাজ রঞ্জিৎ শিং-এর নামে।
উহ! সায়্যিদ আহমদ! উধাম শিং ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্য করে বললেন সেকি দুচারজন লোক জমিয়ে সালারে আলা বনে গেছে?
তিনি যাই হোক, আমি মহারাজ রঞ্জিৎ শিং-এর নামে উনার পয়গাম এনেছি- হিম্মত খান তার আশপাশের শিখদের বেষ্টনীর দিকে তাকিয়ে বললো– আপনাদের অতি নগণ্য লোকও যদি আমাদের ওখানে যায় আমরা তার সঙ্গে এ ধরনের অস্ত্র আচরণ করবো না যেমন আমার সঙ্গে করা হচ্ছে।
এটা একটি কেল্লা নওজোয়ান! আমাদের কিছু নিয়ম কানুন আছে তোমাকে মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবো। তবে তোমার তলোয়ার আমাদের কাছে হাওলা করতে হবে।
নিয়ম কানুন কিছু আমাদেরও আছে–হিম্মত খান বললো–আমাদের ধর্মে দুশমনের কাছে হাতিয়ার হাওলা করাটা পাপ মনে করা হয়। আমি আপনাদের মহারাজাকে হত্যা করতে আসিনি। তাকে একটি পয়গাম দিতে এসেছি।
কিসের পয়গাম? বন্ধুত্বের মুসলমানরা এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।
এর মীমাংসা মহারাজ রঞ্জিৎ সিং-এর জবাবের পর করা হবে। তবে অতিরিক্ত কথা বলার অনুমতি নেই আমার। আমার কাজ শুধু পয়গাম শুনিয়ে দেয়া।
তুমি আজ রাতে আমাদের মেহমান- উধাম শিং-এর গলায় এখন মার্জনার ছোঁয়া- আগামীকাল তোমায় মহারাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। তিনি কাহেন শিংকে বললেন- ওকে মেহমানখানায় পৌঁছে দাও। লক্ষ রাখবে, ওর যেন কোন অসম্মান না হয়। ওর তলোয়ারও থাকবে ওর কাছে।
উধাম শিং হিম্মত খানকে মেহমানখানায় পাঠিয়ে রঞ্জিৎ শিং-এর কাছে চলে গেলেন। রঞ্জিৎ শিং-এর অবস্থা তখন কোন গুরু গম্ভীর বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়ার মতো ছিলো না। তার সামনে ছিলো মদের বড় সুরাহী। কয়েজন তোষামোদে দরবারীকে নিয়ে তিনি মদের মধ্যে ডুবে ছিলেন। উধাম শিংকে দেখে দুহাত প্রসারিত করে বললেন– আরে আমাদের কেল্লাদারও এসে গেছে।
মহারাজ : উধাম শিং রঞ্জিৎ শিংকে বললেন– এই সায়্যিদ আহমদ কি সেই লোক যার কথা আপনি সেদিন বলেছিলেন? আপনি বলেছিলেন সায়্যিদ আহমদ হিন্দুস্থানের লোক। এখন কান্দাহার থেকে পেশাওয়ার এসেছে। আপনি বলেছিলেন, সে কোন আলেম যালেম কিছুই না। একজন জাদুকর মাত্র। যেখানেই যায় সেখানকার মুসলমান তার হাতে বায়আত হয়ে যায় এবং তার ফৌজে শামিল হয়।
একথা বলার এখনই তোমার সময় হলো উধাম শিং? রঞ্জিৎ শিং কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন- তুমি তো কোন নতুন কথা শোেননি? সায়্যিদ আহমদকে তো আমরা এমন কিছু মনে করি না যে এমন মূল্যবান সময়ে তার আলোচনা নিয়ে বসে থাকবো।