বই রিভিউ: “নিমধ্যমা” – হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এমন এক নক্ষত্র যাঁর রচনাগুলো পাঠকদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। তার প্রতিটি উপন্যাস যেন এক নতুন জীবনের গল্প, এক নতুন দিগন্তের সন্ধান। “নিমধ্যমা” তার একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, যা পাঠককে জীবনের নানা দিক, সম্পর্কের জটিলতা এবং সামাজিক পরিস্থিতির গভীরে নিয়ে যায়। এটি শুধুমাত্র একটি গল্প নয়, বরং সমাজের মুখোশ উন্মোচন এবং মানবিক চেতনার এক নিখুঁত প্রদর্শনী।
উপন্যাসের কাহিনি:
“নিমধ্যমা” এর গল্প মূলত এক মধ্যবিত্ত পরিবারের অভ্যন্তরীণ সংকট ও সংঘর্ষের গল্প। এটি এক তরুণী, নিমা, যাঁর জীবন অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু তার জীবনযাত্রায় নানা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। নিমা এমন একজন নারী, যার স্বপ্ন অনেক বড়, কিন্তু সমাজের শৃঙ্খল তাকে প্রতিনিয়ত বাধা দেয়। তার জীবনের অগোছালো পথের মধ্যে চলে আসে নানা সম্পর্কের জটিলতা, সামাজিক প্রতিকূলতা, এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।
নিমার জীবনযাত্রা চিত্রিত করতে লেখক হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্যা, স্বপ্ন, দুঃখ, সুখ এবং একাকিত্বের অনুভূতিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই উপন্যাসে নিমার সংগ্রাম শুধুমাত্র তার নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, তার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার একটি যাত্রা নয়, বরং এটি একটি সাধারণ মানুষের জীবনের অনুষঙ্গী যন্ত্রণা এবং বিজয়েরও কাহিনী।
ভাষা ও শৈলী:
হুমায়ূন আহমেদের ভাষা সবসময়ই সাবলীল এবং পাঠককে সহজে গল্পের ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। “নিমধ্যমা”-তে তার ভাষাশৈলী আরও গভীর এবং প্রাঞ্জল। লেখক যেন চরিত্রদের চিন্তা এবং অনুভূতিকে খুবই বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা পাঠককে তাদের জীবন এবং পরিস্থিতির সঙ্গে সংযুক্ত করে। চরিত্রগুলোর মধ্যে মানবিক দিকের বিশদ চিত্রণ পাঠককে অত্যন্ত আগ্রহী করে তোলে।
হুমায়ূন আহমেদ গল্পে খোলামেলা হাস্যরসের সংমিশ্রণ রেখেছেন, যা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক হয়। পাশাপাশি, কখনও কখনও গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং সামাজিক মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি পাঠককে চিন্তার এক নতুন জগতে প্রবেশ করান।
পাঠককে কী দেয় “নিমধ্যমা”:
“নিমধ্যমা” কেবল একটি উপন্যাস নয়, এটি জীবনের একটি দরকারি শিক্ষা। এটি পাঠকদের সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক চাপ, সম্পর্কের জটিলতা, এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামের মাঝে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। লেখক আমাদের শেখান, কীভাবে আমরা নিজেদের জীবনের লক্ষ্য এবং সত্ত্বাকে বুঝতে পারি, তা সত্ত্বেও আমরা সামাজিক কুসংস্কারের শিকার। এটি পাঠকদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে, তাদের মনে সাহস জোগায় যাতে তারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে চলতে পারে।
এছাড়াও, “নিমধ্যমা” সামাজিক সমস্যা এবং মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্বকে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকভাবে তুলে ধরেছে। সমাজের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং আক্ষেপও এই উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পাঠককে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে – “আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?”
উপসংহার:
সার্বিকভাবে, “নিমধ্যমা” একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম যা পাঠককে জীবন, সম্পর্ক, এবং সমাজের প্রতি গভীর ভাবনায় ডুবিয়ে দেয়। হুমায়ূন আহমেদ তার অমর লেখনীর মাধ্যমে আমাদের এমন এক গল্প উপহার দিয়েছেন যা শুধু এক সময়ের জন্য নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে ওঠে। এটি সমাজের নীরব যন্ত্রণাকে এবং মধ্যবিত্ত জীবনের অজ্ঞাত দুঃখ-সুখকে খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছে।
“নিমধ্যমা” এমন একটি বই যা পাঠককে আত্মপরিচয়, সামাজিক সত্যতা এবং মানুষের অবচেতনতা সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে প্ররোচিত করবে। এটি কেবল এক উপন্যাস নয়, বরং একটি জীবনবোধের কাহিনী যা প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
বইটির ফ্রি সফট কপি ডাউনলোড করুন এখানে-