মেজদিদি – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Mejdidi by Sarat Chandra Chattopadhyay)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

| এক ।
কেষ্টার মা মুড়ি-কড়াই ভাজিয়া, চাহিয়া-চিন্তিয়া অনেক দুঃখে কেষ্টধনকে চোদ্দ বছরেরটি করিয়া মারা গেলে,
গ্রামে তাহার আর দাড়াইবার স্থান রহিল না। বৈমাত্র বড় বোন কাদক্বিনীর অবস্থা ভালো। সবাই কহিল, যা কেন্ট
তোর দিদির বাড়িতে গিয়ে থাক গে। সে বড়মানুষ বেশ থাকবি, যা।
মায়ের দুঃখে কেষ্ট কীদিয়া কাটিয়া জুর করিয়া ফেলিল। শেষে ভালো হইয়া, ভিক্ষা করিয়া শ্রাদ্ধ করিল। তার
পরে ন্যাড়া মাথায় একটি ছোট পুটলি সম্বল করিয়া, দিদির বাড়ি রাজহাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। দিদি তাহাকে
চিনিত না। পরিচয় পাইয়া এবং আগমনের হেতু শুনিয়া একেবারে অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল। সে নিজের নিয়মে
ছেলেপুলে লইয়া ঘরসংসার পাতিয়া বসিয়াছিল-অকস্মাৎ এ কি উৎপাত।
পাড়ার যে বুড়ামানুষটি কেষ্টাকে পথ চিনাইয়া সঙ্গে আসিয়াছিল, তাহাকে কাদদ্বিনী খুব কড়া কড়া দু-চার কথা
শুনাইয়া দিয়া কহিল, ভারী আমার মাসীমার কুটুমকে ডেকে এনেছেন, ভাত মারতে! সতমাকে উদ্দেশ করিয়া
বলিল, বজ্জাত মাগী জ্যান্তে একদিন খোজ নিলে না, এখন মরে গিয়ে ছেলে পাঠিয়ে তত্ব করেছেন। যাও বাপু
তুমি পরের ছেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাও-এ সব ঝঞ্ধাট আমি পোয়াতে পারব না।
বুড়া জাতিতে নাপিত। কেষ্টার মাকে ভক্তি করিত, মা-ঠাকরুন বলিয়া ডাকিত। তাই এত কটুক্তিতেও হাল ছাড়িল
না। কাকুতি-মিনতি করিয়া বলিল, দিদিঠাকরুন লক্ষ্মীর ভাড়ার তোমার। কত দাস-দাসী, অতিথি-ফকির, কুকুর-
বেড়াল এ সংসারে পাত পেতে মানুষ হয়ে যাচ্ছে, এ ছোড়া দু-মুঠো খেয়ে বাইরে পড়ে থাকলে তুমি জানতেও
পারবে না। বড় শান্ত সুবোধ ছেলে দিদি ঠাকরুন! ভাই বলে না নাও, দুঃখী অনাথ বামুনের ছেলে বলেও বাড়ির
কোণে একটু ঠাই দাও দিদি।
এ স্ততিতে পুলিসের দারোগার মন ভেজে, কাদধিনী মেয়ে মানুষ মাত্র। কাজেই সে তখনকার মতো চুপ করিয়া
রহিল। বুড়া কেস্টাকে আড়ালে ডাকিয়া দুটা শলাপরামর্শ দিয়া চোখ মুছিয়া বিদায় লইল।
কেষ্ট আশ্রয় পাইল।
কাদসম্বিনীর স্বামী নবীন মুখুজ্যের ধান-চালের আড়ত ছিল। তিনি বেলা বারোটার পর বাড়ি ফিরিয়া কেস্টাকে বক্র
কটাক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া প্রশ্ন করিলেন, এটি কে?
কাদম্বিনী মুখ ভারী করিয়া জবাব দিল, তোমার বড়কুটুম গো, বড়কুটুম! নাও, খাওয়াও পরাও, মানুষ কর-
পরকালের কাজ হোক ।
নবীন সৎ-শাশুড়ীর মৃত্যু-সংবাদ পাইয়াছিলেন, ব্যাপারটা বুঝিলেন; কহিলেন, বটে! বেশ নধর গোলগাল দেহটি
তো!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top