Dubo Pahar by Abul Asad-42

ডুবো পাহাড় – আবুল আসাদ (Dubo Pahar by Abul Asad)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

সুস্মিতা বালাজীদের তিন তলার হাওয়াখানা।
একে অভজারভেটরিও বলে সুস্মিতারা।
এখানে বসে হ্রদের মত বিশাল সরোবরের উপর দিয়ে আন্দামানের শান্ত নীল সমুদ্র দেখা যায়।
আহমদ মুসার শূন্য দৃষ্টি নীল সাগর পেরিয়ে ছুটছে আরও দূরে, অনেক দূরে- আরব সাগরও পার হয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে জোসেফাইনের মিষ্টি হাসির শান্ত সুন্দর মুখ।
এইমাত্র টেলিফোন করেছিল ডোনা জোসেফাইন। তার রুটিন টেলিফোন। আগে সাত দিন পর পর টেলিফোন করতো। সন্তান আহমদ আব্দুল্লাহ জন্ম নেয়ার পর সাত দিন থেকে নেমে এসেছে এখন তিন দিনে। প্রতি তিন দিন পর সে এখন টেলিফোন করে। ডোনার যুক্তি হল আহমদ আব্দুল্লহ আসার পর তার দায়িত্ব বেড়েছে এবং তার সাথে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। এখন সাত দিন অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তিন দিন পরের ডোনার এই টেলিফোন আহমদ মুসার কাছে অমৃতের মত, যেন প্রানসঞ্জীবনী সুধা। তিন দিনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায় একটি পরিচিত কন্ঠের মিষ্টি সম্বোধনে।
কিন্তূ ডোনা আজ টেলিফোন করেছে দু’দিনের মাথায়।
আজ ডোনা ছিল দারুন খুশি।
ফ্রান্স থেকে তার আব্বা এসেছে এবং রাশিয়া থেকে এসেছে তার মা (ওলগার মা)। কিন্তূ এই খুশির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে জোসেফাইন। বলেছে, ‘এই মুহূর্তে খুব ফিল করছি আমি তোমাকে। মনটা অস্থির লাগছে। চারদিকে আমার সবই আছে, কিন্তূ মনে হচ্ছে কিছুই নেই। হঠাৎ করে শূন্যতার একটা যন্ত্রণা আমাকে ঘিরে ধরেছে। তাই একদিন আগেই তোমাকে টেলিফোন করলাম।’ কথা শেষ করেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠেছে, ‘স্যারি, আমার কথা গুলোকে শাব্দিক অর্থে নিও না। আব্বা, আম্মা এসেছেন তো। তাই মনটা হঠাৎ আনন্দে বাঁধন হারা হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসা উত্তরে বলেছে, কিন্তূ জোসেফান, আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি এ কথা তো ঠিক।’ উত্তরে জোসেফাইনের জবাবটা দীর্ঘ ছিল। বলেছে, কষ্ট পাচ্ছি এ কথা যদি বলি তা ঠিক হবে না। কিন্তূ এ কষ্টে যে সুখ আছে, তা কষ্টের চেয়ে অনেক বড়, এ কথা তুমি অন্তত বুঝবে। কারণ এমন কষ্ট তোমার মাঝেও আছে এবং কষ্টের মধ্যে যে বড় সুখ তা আমার মত তোমাকেও সান্তনা দেয়। আর তুমি আমাকে কোন কষ্ট দাও না। এ কষ্ট যদি কেউ দিয়ে থাকেন তিনি আমার আল্লাহ, বিশ্ব জাহানের প্রভূ। আনন্দের সাথে বুক পেতে এই কষ্ট আমি গ্রহন করেছি। কারণ এর যে পরম জাযাহ তিনি পুরস্কার হিসাবে প্রস্তূত রেখেছেন তা তোমার আমার কল্পনার বাইরে। বল, এরপর তুমি কষ্টের কথা বলতে পার?’ আহমদ মুসা বলেছে, ‘বলতে পার জোসেফাইন। পুরস্কারের অস্তিত্ব যেমন বাস্তব, কষ্টেরও অস্তিত্ব তেমনি বাস্তব। কষ্ট আছে বলেই তো পুরস্কার। তবে আমার খুব ভাল লাগছে জোসেফাইন, আল্লাহর ইচ্ছাকে তুমি এমনভাবে গ্রহন করতে পেরেছ দেখে। তোমার এই ধৈর্য আমাকে আরও শক্তি যোগাবে।’ জোসেফাইন উত্তরে আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বলেছে, ‘সকল প্রসংসা আল্লাহর। আর আল্লাহকে তুমিই আমাকে চিনিয়েছ। আল্লাহর প্রতি এই নির্ভরতা আমি তোমার কাছে থেকেই শিখেছি। আজকের এই যে আমি, তাকে তুমিই গড়েছ। সুতরাং………।’ জোসেফাইনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠেছে, ‘মানুষ একমাত্র আল্লাহই গড়ে জোসেফাইন। আল্লাহরই দেয়া যে আলো আমি তোমার কাছে তুলে ধরেছি, তাঁকে গ্রহন করার শক্তি আল্লাহই তোমাকে দিয়েছেন। এ আলোয় যে আলোর জীবন তুমি পেয়েছ, আল্লাহই দয়া করে তা গড়ে দিয়েছেন। সর্বাবস্থায় সব প্রশংসা আল্লাহর।’ সঙ্গে সঙ্গেই জোসেফাইন বলেছে, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি আমার ভূল শুধরে দিয়েছ। তুমি আমার স্বামী, আমার শিক্ষক। এটা আমার গর্ব।’ আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গেই বলেছে, ‘ব্যাপারটা একতরফা নয় জোসেফাইন। আমাদের কুরআন শরীফে স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের অভিভাবক হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। অভিভাবক শিক্ষকও। সুতরাং শুধু ছাত্রী নয়, শিক্ষকও তুমি।’ হেসে উঠেছিল জোসেফাইন। বলেছে, ‘স্যার যদি ছাত্রীকে স্যারে উন্নতি করেন, তাহলে কোন বোকা ছাত্রী আনন্দে আত্মহারা হবে না।’ আহমদ মুসা বলেছেন, ‘কথাটা ওভাবে নয় এভাবে বল, স্বামী-স্ত্রী দুজনকে সমান আসন দেয়ার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ।’ একটু সময় নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেছে জোসেফাইন, তোমার সমান কথাটার সাথে আমি একমত নই। আল্লাহরব্বুল আলামিন স্ত্রীদের তাদের উপযুক্ত স্থান দিয়েছেন এ জন্য তার শুকরিয়া আদায় করছি। উত্তরে আহমদ মুসা বলেছে, ‘কথাটার মধ্যে প্রতিযোগিতা দরকষাকষি আছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দরকষাকষির নয়, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার। সম্প্রীতি ও সহযোগিতা না থাকলে দরকষাকষির রেজাল্ট খুব ফল দেয়না। আল্লাহ উভয়ের মধ্যে এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার কথাই বলেছেন।’
কথা শেষ জোসেফাইন আবার বলে উঠেছে, ‘তোমার অনেক সময় নিয়েছি, প্রসঙ্গ থেকেও অনেক দূরে সরে এসেছি। শোন, আপাকে বলো আমি টেলিফোন করব। রাখলাম টেলিফোন।’ বাধা দিয়ে আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, রেখো না প্লিজ। একটা দম নিয়ে জোসেফাইন বলেছে, তমার মনটা আজ খুব ফ্রি দেখছি। এমন ফ্রি দেখলে আমার ভয় করে।’ ‘কেন’ বলেছে আহমদ মুসা। ‘তোমার এমন ফ্রি হওয়া তোমার বড় কিছুতে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেয়, বলেছে ডোনা জোসেফাইন। তার কন্ঠ ভারী শোনা যাচ্ছিল। বলেছে আহমদ মুসা, ‘কিন্তূ তুমি তো অনেক শক্ত জোসেফাইন। তোমার দৃঢ়তা আমাকে শক্তি জোগায়।’ জোসেফাইন বলেছে, স্যরি এভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তূ সত্যি কি জান? আহমদ আবদুল্লাহর দিকে চাইলে আমি যেন দুর্বল হয়ে পড়ি। তুমি পাশে থাকলে এ দুর্বলতা আমি অনুভব করি না। বুঝতে পারি, এটা আমার জন্যে শোভনীয় নয়। কিন্তূ……। কথা শেষ করতে পারে না ডোনা জোসেফাইন। গলায় আটকে যায় তার কথা। বেদনার একটা তীক্ষ্ণ ছুরি এসে আঘাত করে আহমদ মুসাকে। বলে সে, তোমার এ চিন্তা শোভনীয় নয় কেন জোসেফাইন, এ চিন্তাই স্বাভাবিক। একজন স্ত্রীর চেয়ে একজন ‘মা-স্ত্রীর’ দায়িত্ব তো বেশি হবেই। দায়িত্ব থেকে আসে চিন্তা, চিন্তার একটা পর্যায় ভয়ও।’ সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছে জোসেফাইন, ‘আমার দুর্বলতার কথা তোমাকে বলেছি সাহস পাওয়ার জন্যে, শক্তি পাব বলে। কিন্তূ এখন দেখছি, দুর্বলতাকে তুমি প্ররোচণা দিচ্ছ, আরও বাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।’ আহমদ মসা বলেছে, আমি এখন শুধু আহমদ মুসা নই, একজনের স্বামী এবং একজনের পিতাও। বলেছে জোসেফাইন, ‘স্যরি, আমি যে কথা বলছি, সে কথা তুমিও বললে। কথা সত্য এবং খুবই বাস্তব। কিন্তূ এই দুর্বলতা আমার জন্যে হয়তো কিছুটা সাজে কিন্তূ তোমার সাজে না। তুমি একজন জোসেফাইনের স্বামী তুমি একজন আহমদ আবদুল্লাহর পিতা, কিন্তূ কোটি কোটি মানুষের তুমি ‘আহনদ মুসা’। আল্লাহর কাছে তুমি আহমদ মুসাই। এই আহমদ মুসা দুর্বল হতে পারে না।’ এক ধরনের আবেগ ঢেউ খেলে উঠেছিল আহমদ মুসার চেহারায়। ডোনা জোসেফাইনের কথাগুলোকে মনে হচ্ছিল অবিস্মরণীয় শিলালিপির এক মূর্তিমান সত্তার মত দেদীপ্যমান। বলে উঠেছিল আহমদ মুসা, ‘জোসেফাইন আমার কৃতজ্ঞতা নাও। তোমার মত স্ত্রী থাকলে কারো পথ হারাবার ভয় নেই। আল্লাহ তোমাকে জাযাহ দান করুন। তুমি শান্তির মরুদ্যান শুধু নাও জোসেফাইন, অব্যাহত প্রেরণার এক মানস সরোবরও।’ আহমদ মুসার কথার পিঠেই ডোনা জোসেফাইন বলে উঠেছিল, হ্যা, মহানজন সূর্য যখন ঘাতক চাঁদের প্রসংসা করে তখন শুনতে ভালোই লাগে।’
ডোনা জোসেফাইনকে নিয়ে আহমদ মুসার এই সুখ চিন্তা আর কতক্ষণ চলতো কে জানে। কিন্তূ চলতে পারলো না। হাওয়াখানায় উঠার সিঁড়ি-মুখের দড়জায় নক হল। ভেঙে গেল আহমদ মুসার সুখ সপ্ন। সাগরের নীল বুক থেকে ফিরে এল তার চোখ।
দরজার পেছনে বসেছিল আহমদ মুসা।
পেছনে একবার তাকাল আহমদ মুসা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top