একটু চোখ বুলিয়ে নিন
আমি এবং আমার আত্বীয় পূজার ছুটিতে দেশভ্রমণ সারিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় রেলগাড়িতে বাবুটির সঙ্গে দেখা হয় তাহার বেশভুষা দেখিয়া প্রথমটা তাহাকে পশ্চিমদেশীয় মুসলমান বলিয়া ভ্রম হইয়াছিল তাহার কথাবার্তা শুনিয়া আরো ধাধা লাগিয়া যায়। পৃথিবীর সকল বিষয়েই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাহার সহিত প্রথম পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন। বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে তবে এমন-সকল অশ্রুতপুর্ব নিগুঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতদ্র অস্রসর হইয়াছে, ইংরাজদের যে এমন-সকল গোপন মতলব আ্ছে, দেশীয় রাজাদের মধ্যে ঘে একটা খিচুড়ি পাকিয়া উঠিয়াছে, এ-সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলাম আমাদের নবপরিচিত আলাপটি ঈবৎ হাসিয়া কহিলেনঃ There happen more things in heaven and earth, Horatio, than are reported in your newspapers. আমরা এই প্রথম ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়াছি, সুতরাং লোকটির রকমসকম দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম । লোকটা সামান্য উপলক্ষে কখনো বিজ্ঞান বলে, কখনো বেদের ব্যাখা করে, আবার হঠাৎ কখনো পার্সি বয়েত আওড়াইতে থাকে । বিজ্ঞান বেদ এবং পার্সি ভাষায় আমাদের কোনোরূপ অধিকার না থাকাতে তাহার প্রতি আমাদের ভক্তি উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল। এমন-কি, আমার থিয়সফিস্ট্ আত্বীয়টির মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, আমাদের এই সহযাত্রীর সহিত কোনো এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের কিছু-একটা যোগ আছে; কোনো একটা অপূর্ব ম্যাগনেটিজম অথবা দৈবশত্তি, অথবা সূক্ষ্ণ শরীর অথবা এ ভাবের একটা-কিছু | তিনি এই অসামান্য লোকের সমস্ত সামান্য কথাও ভক্তিবিহ্বল মুগ্ধভাবে শুনিতেছিলেন এবং গোপনে নোট করিয়া লইতেছিলেন ; আমার ভাবে বোধ হুইল, অসামান্য ব্যক্তিটিও গোপনে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং কিছু খুশি হইয়াছিলেন।
গাড়িটি আসিয়া জংশনে থামিলে আমরা দ্বিতীয় গাড়ির অপেক্ষায় ওয়েটিংরূমে সমবেত হইলাম । তখন রাত্রি সাড়ে দশটা পথের মধ্যে একটা কী ব্যাঘাত হওয়াতে গাড়ি অনেক বিলম্বে আসিবে শুনিলাম। আমি ইতিমধ্যে টেবিলের উপর বিছানা পাতিয়া ঘুমাইব স্থির করিয়াছি, এমন সময়ে সেই অসামান্য ব্যক্তিটি নিম্নলিখিত গল্প ফাদিয়া বসিলেন সে রাত্রে আমার আর ঘুম হুইল না।
রাজাচালনা সম্বন্ধে দুই একটা বিষয়ে মতান্তর হওয়াতে আমি জুনাগড়ের কর্ম ছাড়িয়া দিয়া হাইদ্রাবাদে যখন নিজাম-সরকারে প্রবেশ করিলাম তখন আমাকে অল্পবয়স্ক ও মজবুত লোক দেখিয়া প্রথমে বরীচে তুলার মাশুল-আদায়ে নিযুক্ত করিয়া দিল |
বরীচ জায়গাটি বড়ো রমণীয় নির্জন পাহাড়ের নীচে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া শুস্তা নদীটি (সংস্কৃত স্বচ্ছতোয়ার অপভ্রংশ) উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে । ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথর-বাঁধানো দেড়-শত-সোপান-ময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপরে একটি শ্রেপ্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমূলে একাকী দাড়াইয়া আছে– নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। বরীচের তুলার হাট এবং গ্রাম এখান হইতে দূরে।
প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বে দ্বিতীয় শা-মামুদ ভোগবিলাসের জন্য প্রাসাদটি এই নির্জন স্থানে নির্মাণ করিয়াছিলেন । তখন হইতে স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হুইতে গোলাপগন্ধী জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মরখচিত স্নিগ্ধ শিলাসনে বসিয়া কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া তরুণী পারদিক রমশীগণ স্নানের পূর্বে কেশ মুক্ত করিয়া দিয়া সেতার-কোলে দ্রাক্ষাবনের গজল গান করিত।
এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শুভ্র চরণের সুন্দর আঘাত পড়ে না–এখন ইহা আমাদের মতো নির্জনবাসপীড়িত সঙ্গিনীহীন মাশুল-কালেক্টরের অতি বৃহৎ এবং অতি শূন্য বাসম্থান কিন্তু আপিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খা আমাকে এই প্রাসাদে বাস করিতে বারংবার নিষেধ করিয়াছিল ; বলিয়াছিল, ইচ্ছা হয় দিনের বেলা থাকিবেন, কিন্তু কখনো এখানে রাত্রিযাপন করিবেন না। আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম । ভৃত্যরা বলিল, তাহারা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করিবে কিন্ত রাত্রে এখানে থাকিবে না আমি বলিলাম, তথাস্তু। এ বাড়ির এমন বদনাম ছিল যে রাত্রে চোরও এখানে আসিতে সাহস করিত না।
প্রথম প্রথম আসিয়া এই পরিত্যক্ত পাষাণপ্রাসাদের বিজনতা আমার বুকের উপর যেন একটা ভয়ংকর ভারের মতো চাপিয়া থাকিত, আমি যতটা পারিতাম বাহিরে থাকিয়া অবিশ্রান্ত কাজকর্ম করিয়া রাত্রে ঘরে ফিরিয়া শ্রান্তদেহে নিদ্রা দিতাম
কিন্ত্ব সপ্তাহখানেক না যাইতেই বাড়িটার এক অপূর্ব নেশা আমাকে ক্রমশ আক্রমণ করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্থা বর্ণনা করাও কর্ঠিন এবং সে কথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত | সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্ধের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল।
বোধ হয় এ বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল– কিন্ত্বু আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সূত্রপাত অনুভব করি সের্দিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে
তখন গ্রীষ্মকালের আরম্ভে বাজার নরম ; আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম-কেদারা লইয়া বসিয়াছি তখন শুস্থানদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; ও পারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্নের আভায় রঙ্গিন হইয়া উঠিয়াছে । এ পারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক ঝিক করিতেছে । সেদিন কোথাও বাতাঁস ছিল না। নিকটের পাহাড়ে বনতুলসী পুদিনা ও মৌরির জঙ্গল হইতে একটা ঘন সুগন্ধ উঠিয়া স্থির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল।
সূর্ধ যখন গিরিশিখরের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল তৎক্ষণাৎ দিবসের নার্টাশালার একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল– এখানে পর্বতের ব্যবধান থাকাতে সূর্যাস্তের সময় আলো আধারের সম্মিলন অধিকক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঘোড়ায় চড়িয়া একবার ছুটিয়া বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব উঠিব করিতেছি, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম । পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই।
ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল, যেন অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া নামিয়া আসিতেছে। ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরুপ পুলক মিশ্রিত হুইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। দিও আমার সম্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়াহ্নে একদল প্রমোদচঞ্জল নারী শুস্তার জলের…
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।