একটু চোখ বুলিয়ে নিন
রাজা, পরিষদবর্গ, নটরাজ, নাট্যাচার্য ও গায়ক-গায়িকা
গান আরম্ভ
রাজা । ওহে থামে তোমরা, একটু থামো । আগে ব্যাপারখানা বুঝে নিই। নটরাজ, তোমাদের পালাগানের পুথি একখানা হাতে দাও না।
নটরাজ। (পুথি দিয়া) এই নিন মহারাজ |
রাজা । তোমাদের দেশের অক্ষর ভালো বুঝতে পারিনে। কী লিখছে? “শেষবর্ষণ”।
নটরাজ। হা মহারাজ।
রাজা। আচ্ছা বেশ ভালো । কিন্তু পালাটা যার লেখা সে লোকটা কোথায় ?
নটরাজ। কাটা ধানের সঙ্গে সঙ্গে খেতটাকে তো কেউ ঘরে আনে না। কাব্য লিখেই কবি খালাস, তার পরে জগতে তার মতো অদরকারি আর কিছু নেই । আখের রসটা বেরিয়ে গেলে বাকি যা থাকে তাকে ঘরে রাখা চলে না। তাই সে পালিয়েছে।
রাজা। পরিহাস বলে ঠেকছে। একটু সোজা ভাষায় বলো । পালাল কেন?
নটরাজ। পাছে মহারাজ বলে বসেন, ভাব অর্থ সুর তান লয়, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না সেই ভয়ে । লোকটা বড়ো ভিতু।
রাজকবি। এ তো বড়ো কৌতুক। পাঁজিতে দেখা গেল তিথিটা পূর্ণিমা, এদিকে চাদ মেরেছেন দৌড়, পাছে কেউ বলে বসে তার আলো ঝাপসা।
রাজা । তোমাদের কবিশেখরের নাম শুনেই মধুকপত্তনের রাজার কাছ থেকে তার গানের দলকে আনিয়ে নিলেম, আর তিনি পালালেন ?
নটরাজ। ক্ষতি হবে না, গানগুলো সুদ্ধ পালান নি। অস্তসূর্য নিজে লুকিয়েছেন কিন্তু মেঘে মেঘ রঙ ছড়িয়ে আছে।
রাজকবি। তুমি বুঝি সেই মেঘ ? কিন্তু তোমাকে দেখাচ্ছে বড়ো সাদা।
নটরাজ। ভয় নেই, এই সাদার ভিতর থেকেই ক্রমে ক্রমে রঙ খুলতে থাকবে৷
রাজা । কিন্তু আমার রাজবুদ্ধি, কবির বুদ্ধির সঙ্গে যদি না মেলে ? আমাকে বোঝবে কে?
নটরাজ। সে ভার আমার উপর । ইশারায় বুঝিয়ে দেব।
রাজা । আমার কাছে ইশারা চলবে না। বিদ্যুতের ইশারার চেয়ে বজ্রের বাণী স্পষ্ট, তাতে ভুল বোঝার আশঙ্কা নেই। আমি স্পষ্ট কথা চাই। পালাটা আরম্ভ হবে কী দিয়ে?
নটরাজ। বর্ষাকে আহ্বান ক’রে।
রাজা। বর্ষাকে আহ্বান ? এই আশ্বিন মাসে?
রাজকবি। ঋতু-উৎসবের শবসাধনা ? কবিশেখর ভূতকালকে খাড়া ক’রে তুলবেন । অদ্ভুত রসের কীর্তন।
নটরাজ। কবি বলেন, বর্ষাকে না জানলে শরৎ-কে চেনা যায় না। আগে আবরণ তার পরে আলো।
রাজা । পোরিষদের প্রতি) মানে কী হে?
পরিষদ। মহারাজ, আমি ওদের দেশের পরিচয় জানি । ওদের হেয়ালি বরঞ্চ বোঝা যায় কিন্তু যখন ব্যাখ্যা করতে বসেন তখন একেবারেই হাল ছেড়ে দিতে হয়।
রাজকবি। যেন দৌপদীর বস্ত্রহরণ, টানলে আরও বাড়তে থাকে ।
নটরাজ। বোঝবার কঠিন চেষ্টা করবেন না মহারাজ, তাহলেই সহজে বুঝবেন । জুই ফুলকে ছিড়ে দেখলে বোঝা যায় না, চেয়ে দেখলে বোঝা যায় । আদেশ করুন এখন বর্ষাকে ডাকি।
রাজা । রসো রেসো। বর্ষাকে ডাকা কী রকম ? বর্ষা তো নিজেই ডাক দিয়ে আসে
নটরাজ। সে তো আসে বাইরের আকাশে । অন্তরে আকাশে তাকে গান গেয়ে ডেকে আনতে হয়।
রাজা। গানের সুরগুলো কি কবিশেখরের নিজেরই বাধা?
নটরাজ। হা মহারাজ।
রাজা । এই আর এক বিপদ।
রাজকবি। নিজের অধিকারে পেয়ে কাব্যরসের হাতে কবি রাগিণীর দুর্গতি ঘটাবেন। এখন রাজার কর্তব্য গীতসরস্বতীকে কাব্যপীড়ার হাত থেকে রক্ষা করা। মহারাজ, ভোজপুরের গন্ধর্ব দলকে খবর দিন না। দুই পক্ষের লড়াই বাধুক তা হলে কবির পক্ষে “শেষ বর্ষণ” নামটা সার্থক হবে।
নটরাজ। রাগিণী যতদিন কুমারী ততদিন তিনি স্বতন্ত্র, কাব্যরসের সঙ্গে পরিণয় ঘটলেই তখন ভাবের সেই স্ত্রৈণতা অসহ্য । অন্তত আমার দেশের চাল এ রকম নয়।
রাজা । ওহে নটরাজ, রস জিনিসটা স্পষ্ট নয়, রাগিণী জিনিসটা স্পষ্ট । রসের নাগাল যদি বা না পাই, রাগিণীটা বুঝি। তোমাদের কবি কাব্যশাসনে তাকেও যদি বেধে ফেলেন তা হলে তো আমার মতো লোকের মুশকিল ।
নটরাজ। মহারাজ, গাঠছড়ার বাধন কি বাধন ? সেই বাধনেই মিলন । তাতে উভয়েই উভয়কে বাধে । কথায় সুরে হয় একাত্না।
পরিষদ । অলমতিবিস্তরেণ। তোমাদের ধর্মে যা বলে তাই করো, আমরা বীরের মতো সহ্য করব।
নটরাজ । গোয়কগায়িকাদের প্রতি) ঘনমেঘে তার চরণ পড়েছে। শ্রাবণের ধারায় তার বাণী কদম্বের বনে তার গন্ধের অদৃশ্য উত্তরীয়। গানের আসনে তাকে বসাও, সুরে তিনি রূপ ধরুন, হৃদয়ে তার সভা জমুক।
ডাকো–
এস নীপবনে ছায়াবীথিতলে,
এস করো স্নান নবধারাজলে।
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,
পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ;
কাজল নয়নে যূখীমালা গলে
এস নীপবনে ছায়বীথিতলে।
আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি, সখী,
অধরের নয়নে উঠুক চমকি।
মল্লারগানে তব মধুস্বরে
দিক্ বাণী আনি বনমর্মরে।
ঘন বরিষনে জল-কলকলে
এস নীপবনে ছায়াবীথিতলে।
নটরাজ। মহারাজ, এখন একবার ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, “রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া গরজন,
রিমঝিম শবদে বরিষে।
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।