বিস্মরণ – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Bisshoron – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

ঝিক্‌ ঝিক্‌ ঝিক্‌ ঝিক্‌, ঝিক্‌ ঝিক ঝিক্‌ ঝিক্‌। কু…উ…উ…

মনটা পালাই পালাই করছিল। ভাল লাগল না রানার কাছে কলম্বো । প্রকাণ্ড সব অট্টালিকা, প্রশস্ত সব রাজপথ, লোকে লোকারণ্য বাজার । দু’দিনেই হাপিয়ে উঠল সে। বন্দরের সার্বক্ষণিক কর্মব্যস্ততা থেকে পালিয়ে তাই চলেছে রানা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খোঁজে… সিলোনের অন্তরের কাছাকাছি। কান্ডিতে দু’দিন জিরিয়ে নিয়ে কর্ণগাল, অনুরাধাপুর হয়ে চলে যাবে জাফনা কিংবা মান্নার । তারপর যাবে ইস্টার্ন প্রভিন্সের ট্রিঙ্কোমালি, বাটিকালোয়া। যদি ভাল না লাগে সাউদার্ন প্রভিন্সের গল্‌-এ গিয়ে কাটিয়ে আসবে ক’দিন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্যাসিনো দেখার ইচ্ছে ছিল–দেখে নেবে এবার। মন যা চায় তাই করবে সে এই একমাস। ছুটি!

ঝিক্‌ ঝিক্‌ ঝিক্‌ ঝিক্‌, ঝিক্‌ ঝিক ঝিক্‌ ঝিক্‌। কু…উ…উ…

পূর্ণবেগে ছুটে চলেছে ট্রেন। ব্রডগজ লাইন–প্রাণ খুলে স্পীড তুলেছে ড্রাইভার । হেনারাতগোদা, পল্‌ পাহাবেলা ছাড়িয়ে পুব দিকে চলেছে এবার ট্রেন। বাইরে সবুজের সমারোহ । ফার্স্ট ক্লাস কামরার এক কোণে নরম গদিতে হেলান দিয়ে বসে ট্রেনের দোলায় দুলছে রানা, আর তাকিয়ে আছে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে । কখনও জঙ্গল, কখনও চা বাগান, কখনও রাবার গাছের সারি, আবার কখনও মাঠভর্তি সবুজ ধান দুলে উঠছে হাওয়া লেগে। সারাটা দেশ জুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য নারকেল গাছ দাড়িয়ে আছে একপায়ে। নিঃসঙ্গ ।

এবার ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠছে ট্রেন। মাঝে মাঝে উচু পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে, কোথাও গভীর খাদ, কোথাও উচ্ছল ঝর্ণা, কোথাও ছোট্ট জলপ্রপাত । কখনও বা ট্রেন চলেছে টানেলের মধ্য দিয়ে। অপূর্ব সব দৃশ্য ।

রানা ভাবছে, সত্যিই হাপিয়ে উঠেছে সে। বিশ্রাম দরকার । এবারের ছুটিতে দেহমন থেকে সমস্ত গ্লানি সমস্ত কালিমা মুছে ফেলতে হবে। অনেক অনেক মানুষের রক্ত লেগে গেছে ওর হাতে । মানুষের জীবন নিয়ে অনেক ছিনিমিনি খেলা
খেলেছে সে। হুকুমের চাকর মনে করে নিজেকে যতই ভুলিয়ে রাখবার চেষ্টা করুক না কেন, কর্তব্য ইজ কর্তব্য বলে যতই প্রবোধ দিক মনকে, যতই ভাবুক এসব কথা ভাবব না-অনেক দিন থেকে ধীরে ধীরে জমেছে এই কালিমা । হাপিয়ে তুলেছে রানাকে । নিজেকে ভিখিরির ছেঁড়া, নোংরা, দুর্গন্দযুক্ত কাথার মত মনে হচ্ছে ওর।

হত্যাকে ঘৃণা করে রানা । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই “হয় মারো, নয় মরো’ অবস্থা বাধ্য করেছে ওকে নরহত্যায়। ওকে শেখানো হয়েছে, একজন স্পাই হিসেবে ডাক্তারের মতই ঠাণ্ডা মাথায় গ্রহণ করতে হবে মৃত্যুকে । বিচলিত হলে চলবে না। তেমন কিছু যদি ঘটে, ভুলে যেতে হবে তৎক্ষণাৎ ‘আত্মগ্লানিকে প্রশ্রয় দিলেই চেপে ধরবে সে আরও ।

কিন্তু ও কি কসাই? এইসব মহারথীদের কি করে রোঝাবে রানা, চোখের সামনে একটি প্রাণকে স্তব্দ হয়ে যেতে দেখলে ভুলে থাকা যায় না কিছুতেই। কি আশ্চর্যভাবে বদলে যায় মানুষ মৃত্যুর ঠিক পরমুহুর্তেই। এই ছিল, এই নেই। লোকটার একটা নাম ছিল, একটা ঠিকানা ছিল, হয়তো একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল- কি যেন বেরিয়ে গেল ওর মধ্য থেকে, ব্যস সব আবর্জনা।

আবার ভাবছে কেন সে? মন থেকে এই সব ভাবনা দূর করবার জন্যেই না সে ছুটি নিয়ে এসেছে সিংহলে? অতীত ভুলে যাবে রানা | সব ভুলে যাবে। বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে হালকা করে নেবে মনটাকে। বর্তমান ছাড়া আর কোন কিছুই সত্য নয় ওর কাছে।

সহযাত্রীদের উপর আরেকবার চোখ বুলাল রানা ।

কামরার প্যাসেঞ্জার মোট পাঁচজন। এক পিনে আশি রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন সিলোন ইউনিভার্সিটির একজন প্রবীণ আত্মভোলা প্রফেসর- দুইজন ছাত্র গোগ্রাসে গিলছে সে-সব। প্রফেসরের দুই কানের পাশে সামান্য পাকা চুল, আর সারাটা মাথা জুড়ে রাজত্ব করছে একটি চকচকে প্রতিভাদীপ্ত টাক। রানাকেও দলে টানবার চেষ্টা করেছিলেন বৃদ্ধ নানান কৌশলে কিন্তু রানা কিছুতেই টোপ গেলেনি, মাথাটা একটু ঝাকিয়ে সায় দিয়েই আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে যাওয়ার ভান করেছে বাইরের দিকে চেয়ে। বার কয়েক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে দুই শ্রোতাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে প্রফেসরকে। অনর্গল জানবর্ষণ করে চলেছেন তিনি অনন্যোপায় দুই যুবকের উপর । সিলোনের ন্যাশনাল ইকনমির উপর বক্তৃতা চলেছে এখন। প্রয়োজনের অর্ধেক খাদ্য উৎপাদন করছে সিলোন, ভরসা এখন চা,
রাবার এবং নারকেল । কিন্ত ওয়ার্লড মার্কেট যেভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে, তার উপর লোকসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরেই ইত্যাদি ইত্যাদি।

পঞ্চম যাত্রীটি গত স্টেশন থেকে উঠেছে । ওর দিকে একবার চেয়েই নির্দ্বধায় ক্ষমা করে দিয়েছেন ওকে প্রফেসর । অত্যন্ত রোগা চেহারা, মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ, তার উপর বেটে । বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে । পরনে সাদা কালো কাজ করা সারং (লুঙ্গির মত সিংহলী কাপড়), গলা পর্যন্ত বোতাম আটা কলারহীন সাদা লম্বা শার্ট, আর শার্টের উপর একটা ওয়েস্ট কোট। চুলগুলো পরিপাটি করে আচড়ানো। হাতে একটা দামী ব্রিফকেস। বেমানান বেখাপ্পা লাগছে ওকে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে। রানার মুখোমুখি কাচুমাচু মুখে জড়সড় ভঙ্গিতে বসে আছে লোকটা । যেন সবার অবহেলা আর অবজ্ঞা সম্পর্কে সচেতন সে।

চায়ের তেষ্টা পেতেই বাঙ্কের উপর থেকে ফ্লাস্কটা নামাল রানা । ভদ্রতার খাতিরে সামনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “খাবেন? দেব এক কাপ?”

এই একটি কথায় যেন পাল্টে গেল লোকটির জগৎ। অদ্ভুত এক কৃতার্থ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সঙ্কুচিত লোকটার মুখ । চলে এল সে রানার পাশে।

দেবেন? দেন, খাই এক কাপ। বলছেন যখন, খাওয়াই উচিত । কিন্তু ফ্লাস্কে রাখা চা–ও চা কি আর খাওয়ার যোগ্য আছে, মশায়? বত্রিশ রকমের চা বানাতে পারি আমি । আমাকে আপনি কি চা খাওয়াবেন, আমার হাতের চা খেলে জীবনে ভুলতে পারবেন না।’ হঠাৎ গলার স্বর পরিবর্তন করে বলল, বেড়াতে এসেছেন বুঝি? টুরিস্ট?”

হ্যা।’

ফ্লাস্কের এক্সট্রা কাভারে চা ঢেলে এগিয়ে দিল রানা । প্রথমেই নাকের কাছে নিয়ে শুকে দেখল লোকটা । বলল, “অরেঞ্জ পেকো। এর সাথে বাজে চা-ও মেশানো আছে। আপনাকে সোজা লোক পেয়ে ঠকিয়ে দিয়েছে ।’ পড়ত যদি আমার পাল্লায়! সুড়ুৎ করে একটা টান দিয়েই প্যাঁচার মত হয়ে গেল লোকটার চেহারা । “ইশশৃ! অরেঞ্জ পেকোর জাত মেরে দিয়েছে, মশাই । নাহ্‌, আপনাকে এক কাপ চা না খাওয়াতে পারলে মনের খেদ যাবে না আমার । চলেছেন কোথায়? ক্যান্ডি?

হ্যা।’
উঠছেন কোথায়? নাথ হোটেলে নিশ্চয়ই?

ঠিক নেই…

“তবে চলুন আমার ওখানে উঠবেন । অবশ্যি গরীবখানা । আপনার রুচিতে-“””

“আমার পরিচয় জানলে এ অনুরোধ হয়তো করতেন না আপনি ।’

“কেন? আপনি বাঘ না ভালুক?’

“আমি মুসলমান ।’

হো হো করে হেসে উঠল দুর্বল লোকটা । বলল, “পাঁচ লাখ মুসলমান আছে সিংহলে, তা জানেন? আমরা ওদেরকে “মুর” বলি। ওদের সঙ্গে তো আমাদের কোন ঝগড়া নেই । রায়ট হয় সিংহলী আর তামিলের মধ্যে । আর মুসলমান হলে কি হয়েছে, আমার হোটেল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-কিশ্চান সবার জন্যে খোলা ।’

“হোটেল আছে নাকি আপনার?’ জিজ্ঞেস করল রানা ।

“বাহ! হোটেল নেই? তবে আর বললাম কি? নিজের হাতে চা বানিয়ে বেচে ছোট্ট রেস্টুরেন্টকে দোতলা হোটেল বানিয়ে ফেলেছি না? এক বছর হলো বিয়েও করে ফেলেছি। খুব সুন্দর বউ । ওকেও শিখিয়ে দিয়েছি চা বানানো । চলেন না
আগে, সবই দেখতে পাবেন । আপনি আমার গেস্ট ।

রানা ভাবল, আরে, এ দেখছি আরেক প্রফেসর । চা খাইয়ে মহা ঝামেলায় পড়া গেল তো। হ্যা-না কোনও জবাব দিল না সে, ভাবল, স্টেশনে নেমে কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু চা শেষ করেই আবার প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করল রানাকে
দুর্বল লোকটা ।

‘নামটা কি মশায়ের?

“মাসুদ রানা । আপনার?

আমার নাম থিরুগণসম্পন্দমুথিউনাইনার পিল্লাই।

রানার মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘শাব্বাশ!’

কথাটা গায়ে মাখল না লোকটা । বলল, “হ্যা । নামটা একটু বড়ই । ইচ্ছে করলে থিরু বলতে পারেন, কিংবা পিল্লাই-ও বলতে পারেন ।’

কাণ্ডি স্টেশনে গাড়ি থামতেই, হুড়মুড় করে উঠে এল দু’তিনটে কুলী। একজনের মাথায় সুটকেসটা চাপিয়ে দিয়ে রানাকে ইঙ্গিত করল থির ওর পিছন পিছন যাবার জন্যে । বীর হনুমানের মত চলল সে আগে আগে। উপায়ান্তর না দেখে ওর পিছন পিছন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে একা গাড়িতে চেপে বসল রানা থিরুর পাশে।

সন্ধের আর বেশি দেরি নেই । কাণ্ডির দর্শনীয় জিনিসগুলো দেখাতে দেখাতে চলল থিরু । প্রকাণ্ড একটা পাঁচতলা দালানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই দেখেন নাথ লাগজারি হোটেল। মালিক হচ্ছেন রঘুনাথ জয়ামান্নে। ওই যে
স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে-ওইটাও । শুধু এগুলো কেন, কাণ্ডির অর্ধেকই আসলে রঘুনাথের।

রানা চেয়ে দেখল একটা পাহাড়ের মাথায় বেশ বড় একটা স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে। মাঠের চারদিক থেকে ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা দেখে মনে হলো রাতেও খেলা হয় এখানে ।

“স্টেডিয়ামটা সরকারী না?” জিজ্ঞেস করল রানা ।

‘না। কাণ্ডির আইন-কানুন আলাদা । ওটা রঘুনাথের ৷ ও হচ্ছে কাণ্ডির রাদালা (সরদার)। সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতা ওর । সবাই ভয় করে চলে ওকে। প্রত্যেক রবিবার কুস্তি হয় ওই স্টেডিয়ামে । এটা তো কিছুই না, মস্ত বড় দুটো টী এস্টেট আছে রঘুনাথের। এছাড়াও আছে রাবার আর নানান ধরনের দামী পাথরের ব্যবসা । যাকগে, ওর আছে, থাকুক । এবার বায়ে যেতে হবে । এই গাড়োয়ান–”

থিরুগনসম্প–” মানে প্রকাণ্ড নামের এই দুর্বল লোকটাকে রানার বেশ ভাল লাগল। খুবই সদালাপী। চেহারা যেমনই হোক ভিতরে একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ আছে। এই অল্পক্ষণের আলাপের মধ্যেই বহু গল্প শুনিয়ে ফেলেছে সে রানাকে।
ওরা তামিল। বিশ-তিরিশ পুরুষ ধরে আছে কান্ডিতে স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে । খুবই গরীব অবস্থা থেকে পরিশ্রম এবং বুদ্ধি বলে আজ কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখতে পেয়েছে । বউ ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই । পল্‌ পাহাবেলা গিয়েছিল ব্যবসার কাজে ।

নিচে রেস্তোরা, দোতলায় হোটেল। একটা বেয়ারার মাথায় রানার সুটকেস চাপিয়ে দোতলায় পাঠিয়ে দিল থিরু ৷ রানাকে বলল, চলেন, আগে চা খাওয়া যাক।

তিনটে ধাপ উঠেই ছোট্ট একটা বারান্দা পেরিয়ে রেস্তোরার সুইং ডোর। দু’পাট খোলা রয়েছে সুইং ডোর, ম্লান ফ্লোরেসেন্ট আলোয় ভিতরটা এক নজর দেখে নিল রানা । হঠাৎ থমকে দাড়াল সে। থিরুও !

বেশ বড় ঘর । আট-দশটা টেবিল ছড়ানো ছিটানো আছে ঘরের মধ্যে । মাত্র তিনটে টেবিলে লোক, বাকিগুলো খালি। একটা টেবিলে বেয়ারা নাস্তা দিচ্ছে খরিদ্দারের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। দরজার কাছের টেবিলটায় আধ-ময়লা কাপড় পরা দু’জন মাঝবয়েসী লোক । আর কোণের টেবিলে প্রকাণ্ড চেহারার একজন লোক বসে আছে দরজার দিকে পিছনে ফিরে বিরাট কাধ, ঢোলা শার্টের হাতা গুটানো, ভীম দুই বাহু দেখা যাচ্ছে। তার উল্টোদিকে বসে আছে টাকমাথা মোটাসোটা এক বয়স্ক লোক।

অল্পবয়েসী চলনসই-সুন্দরী একটি মেয়ে চার-পাঁচটা চায়ের কাপ সাজানো একটা ট্রে দু’হাতে ধরে এসে দাড়িয়েছিল প্রকাণ্ড লোকটির টেবিলের সামনে । একটা কাপ মাত্র নামিয়েছে, এমন সময় মেয়েটির দিকে চেয়ে অশ্লীল হাসি হেসে
চোখ টিপল প্রকাণ্ড লোকটা । ডানহাতে মেয়েটির হাটুর কাছে চেপে ধরল।

সঙ্গে সঙ্গে শক্ত আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটির শরীর | ট্রে-টা পড়ে যাচ্ছিল হাত থেকে, সামলে নিয়ে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না। শক্ত করে পা-টা চেপে ধরে বেহায়ার মত হাসছে লোকটা। রানা ভাবল এখুনি চটাশ করে
চড় মারবে মেয়েটি | কিন্তু তা না করে নিচু হয়ে হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে! হোটেলে অশোভন কেলেঙ্কারি কোনও কাণ্ড ঘটাতে চায় না সে? কিন্তু শক্তিতে কুলাল না। হাতটা হাটু বেয়ে উঠে আসছে উপরে ।

এগোতে গিয়েও থেমে গেল রানা। কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলেও বুঝতে পেরেছে সে এই মেয়েটিই থিরুর সুন্দরী স্ত্রী। থিরুর সামনে রানা তার স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে ওর আত্মসম্মানে লাগতে পারে।

বুলেটের মত ছুটে গেল থিরু কোণের টেবিলটার দিকে ।

থিরুকে দেখতে পেয়েই প্রকাণ্ড লোকটার বাহুর উপর টোকা দিয়ে কি যেন বলল মোটা লোকটা । বাম হাতে এক ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল সে মোটা লোকের হাত। ব্যথা পেয়ে মুখ কুচকাল মোটা । ঘাড় ফিরিয়ে থিরুকে দেখল
একবার দৈত্য । তাচ্ছিল্য ফুটে রয়েছে সে দৃষ্টিতে।

“শালা, রোদিয়ার (গণিকা) বাচ্চা, হারামখোর–‘

ধাঁই করে এক কিল মারল থিরু লোকটার নাকের উপর। মেয়েটার পা ছেড়ে দিয়ে এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দিল লোকটা তাকে দশ হাত তফাতে । একটা চেয়ার উল্টে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেয়েটা । ট্রেটা হাত থেকে পড়ে ঝন্ঝন করে ভেঙে গেল তিনটে কাপ তশতরী । আরেকটা ঘুসি মারল থিরু, চেয়ার ছেড়ে না উঠেই বিদ্যুত্গতিতে মাথাটা একটু পিছনে সরিয়ে নিল লোকটা । ঘুসি লক্ষ্যভ্রস্ট হওয়ায় ব্যালান্স হারিয়ে সামনে এগিয়ে গেল থিরু খানিকটা । ঠিক সেই সময়ই পেটের উপর দড়াম করে ঘুসি পড়ল একটা । ব্রিফকেসটা খসে পড়ল বা হাত থেকে,
ছিটকে কাউন্টারের পিতলের রেলিং এর উপর গিয়ে পড়ল থিরু, অখান থেকে ঝুপ করে মাটিতে । হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসে হাপাচ্ছে সে । দম নিতে পারছে না ভাল মত।

উঠে দাড়াল প্রকাণ্ড লোকটা চেয়ার ছেড়ে । রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রয়েছে ঘরের সবাই ওর দিকে।

“চল হে, যাই । জমবে না এখানে, বলল সে মোটা টেকো লোকটাকে ।

‘ছি! এটা কি করলে, বীরবর্ধন? কাজটা কি…” রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে মোটা লোকটা ।

‘চোপ রাও! এক কথায় থামিয়ে দিল বীরবর্ধন মোটাকে। উঠে দাড়াবার চেষ্টা করছিল থিরু। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল সে থিরুর কাছে । বলল, “অতিরিক্ত আস্পর্ধা হয়ে গেছে তোর, ব্যাটা ইদুরের বাচ্চা! আমার গায়ে হাত তুলিস! পিষে ফেলে দেব না! প্রচণ্ড এক লাখি- তুলল সে।

তিন লাফে পৌছে গেল রানা । পিছন থেকে ধরে ফেলল বীরবর্ধনের শার্টের কলার, সরিয়ে আনল দুই পা, পাই করে একপাক ঘুরে রানার দিকে ফিরল দৈত্য । টাশশ্‌ করে পিস্তলের আওয়াজ তুলল রানার হাতের শক্ত চড় লোকটার গালে লেগে।

প্রচণ্ড জোরে মেরেছে রানা চড়টা। ব্যথা দেবার উদ্দেশ্যেই । দু’পা পিছিয়ে গেল বীরবর্ধন। পানি বেরিয়ে এল দুই চোখ থেকে । মোলায়েম কণ্ঠে বলল রানা, ‘লাথি যদি মারতেই হয়, আমাকে মারো, বাছা । পা দুটো ভেঙে দিয়ে ঠেলাগাড়িতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

পাগলের মত ঘুসি বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বীরবর্ধন রানার উপর। রাগে অন্ধ না হয়ে গেলে কেউ কাউকে এভাবে আক্রমণ করে না। ওই ঘুসি হাতীর পিঠে পড়লে সে-পিঠ বাকা হয়ে যাবে। কিন্তু রানাকে এতখানি তুচ্ছ মনে না করলেই ভাল করতো বেচারা । অন্তত ডিফেন্স গার্ড রেখে ভারপর এগোনো উচিত ছিল ওর ।

বিদ্যুৎবেগে সেঁটে গেল রানা বীরবর্ধনের গায়ের সঙ্গে । মাঝের আঙুলটা আধ ইঞ্চি সামনে বাড়িয়ে রেখে ছয়, ইঞ্চি তফাৎ থেকে ঘুসি চালাল রানা ওর টাকরার নরম মাংসের উপর । পরমুহূর্তে বা হাতের আঙুলগুলো সোজা রেখে ঝটাং করে মেরে দিল নাকের দুই ফুটোর মাঝখানের নরম হাড়ের উপর । কলকল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক থেকে । টলছে বীরবর্ধন। এক পা পিছিয়ে এসে নক আউট পাঞ্ক ষাল রানা এবার ওর চোয়ালের ওপর । দড়াম করে শানের উপর আছড়ে পড়ল বীরবর্ধনের পাহাড়-প্রমাণ ধড়। নাকটা ভেঙে গিয়েছে আগেই, এবারে সুপারির মত ফুলে উঠল কপালের একপাশ!

মোটা লোকটার দিকে ফিরল রানা । বলল. “দূর হয়ে যাও এখান থেকে এই গর্দভকে নিয়ে । এক্ষুণি! নইলে তোমারও এই দশা করে দেব।”

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে মোটা লোকটা ধরাশায়ী বীরবর্ধনের দিকে। দুই চোখে অবিশ্বাস। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে-দেহটার উপর। রানা চলে এল পাশে । হাত ধরে উঠে দাড়াতে সাহায্য করল ওকে । রাগে কাপছে তখনও
থিরু, আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল বীরবর্ধনের উপর, ঠেকাল রানা । বলল, ‘গাধা পিটালে মানুষ হয় না। কেন খামোকা নিজের হাত ব্যথা করবেন? যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে ওর। ছেড়ে দিন, মাফ করে দিন এবারের মত ।

মেয়েটি এসে থিরুর একটা হাত ধরল। বেয়ারা ভাঙা কাপ তশতরী পরিষ্কার করবার জন্যে ঝাঁটা নিয়ে এসেছে। থিরুকে ওর স্ত্রীর হাতে সমর্পণ করে মোটা লোকটার না খাওয়া চায়ের কাপটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চুমুক দিল রানা।

জ্ঞান হারিয়েছে বীরবর্ধন। ঝাঁকি দিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে মোটা লোকটা। কিন্তু পাহাড় নড়ে না। অসহায়ভাবে এদিকে ওদিকে মাথা নাড়াচ্ছে মোটা । হাক ছাড়ল রানা ।

“কি হলো? গেলে না এখনও?

রানার দিকে চাইল মোটা লোকটা করুণ দৃষ্টিতে । যেন এক্ষুণি কেদে ফেলবে । বলল, “রোববার কুস্তি আছে ছেলেটার আর আজ ওর নাকটা ভেঙে দিলেন আপনি?

“ঘাড়টা যে মটকে দিইনি এই বেশি । জলদি কেটে পড়ো, নইলে বাকি টকু কমপ্লিট করে দেব।

নড়েচেড়ে উঠল বীরবর্ধন, একটা অস্ফুট গোঙানি, বেরোল ওর মুখ দিয়ে, তারপর উঠে বসল। বাম গালে পাঁচ আঙুলের দাগ, চোয়ালটা ঝুলে আছে একটু, নাকটা আর দর্শনযোগ্য নেই। অনেক কষ্টে তুলে দাড় করাল ওকে মোটা লোকটা । রানার দিকে একবারও চাইল না বারবর্ধন, সঙ্গীর কাধে ভর দিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে ।

“কেটে পড়ুন!’ কানের কাছে নিচু স্বরে কথা বলে উঠল কে যেন। রানা চেয়ে দেখল একজন খরিদ্দার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে ওর কাছে । চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা । আবার বলল সে, “ভাল চান তো এক্ষুণি কেটে পড়ুন মশায়। কাকে মেরেছেন জানেন? ও হচ্ছে কাণ্ডির সেরা ফাইটার বীরবর্ধন। হাম্বানটোটার চাম্পিয়ানের সঙ্গে আগামী পরশু খেলা আছে ওর স্টেডিয়ামে । লাখ লাখ টাকা বাজি ধরা হয়েছে । আমি ঠাট্টা করছি না। কাণ্ডি ছেড়ে এক্ষুণি পালিয়ে যান। রঘুনাথের কানে এই খবরটা গেলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে আপনার । ভয়ঙ্কর লোক এই রঘুনাথ। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান ও টের পাবার আগেই ।’

দুই

স্বামী-স্ত্রীর সাধাসাধিতে বেশি খেয়ে ফেলল রানা । অষ্টব্যঞ্জন তৈরি করেছে লীলা অতিথির জন্যে। ঝাল একটু বেশি, আর নারকেলের একটু বেশি ছড়াছড়ি, তাছাড়া পেট পুরে খেল রানা । অনেক গল্প শোনাল থিরু ৷ এটা-ওটা-সেটা জোর করে খাওয়াল লীলা । নিজের হাতে তৈরি চাটনি আচার বাধ্য করল চেখে দেখতে । খাওয়া শেষ হয়ে আসতেই দুই মিনিটের জন্যে গায়েব হয়ে গিয়েছিল রান্নাঘরের ভিতর, হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখল রানা একটা থালায় পাহাড়সমান উচু মিষ্টি নিয়ে ফিরছে সে। সর্বনাশ! প্রমাদ গুনল রানা । এমনিতেই হাসফাস অবস্থা, তার উপর
যদি–ওরেব্বাপরেবাপ, অসম্ভব! জান বাচানো ফরজ । অবলীলাক্রমে মিথ্যে কথা বলল সে। ডাক্তারের নিষেধ ।

এর ওপর কথা চলে না । কাজেই আবার রওনা হলো লীলা রান্নাঘরের দিকে ।

‘ভাহলে কিছু ফল মূল কেটে নিয়ে আসি |

‘দোহাই আপনার প্লীজ। একটা কথা শুনুন, আধগ্লাস পানি খেয়ে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল রানা গ্লাসটা । “সত্যি বলছি, এই পর্যন্ত ভরে গেছে, আর পারব না। এমনিতেই অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছি এরপর যদি জোর করেন তাহলে আর চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারব না ।’

রানার করুণ মিনতি শুনে হেসে ফেলল লীলা । বলল, “আচ্ছা, থাক তাহলে ।
এবার চা নিয়ে আসি ।’

‘হ্যা। চা খাওয়া যায়।’

চট করে উঠে পড়বেন না যেন আবার। কথা আছে।’ চলে গেল লীলা লীলায়িত ভঙ্গিতে ।

সিগারেট ধরাল রানা । কিছুক্ষণ যাবৎ গম্ভীর মুখে কি যেন চিন্তা করছে থিরু। কিছুক্ষণ কেন, সন্ধের সেই ঘটনার পর থেকেই কথা কম বলছে সে। রানাকে দোতলায় ওর কামরা দেখিয়ে দিয়ে বউয়ের সঙ্গে কি নিয়ে যেন আলোচনা করেছে সে অনেকক্ষণ। স্নান সেরে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেমে এসেছে রানা নিচে-তখনও কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে, রানাকে দেখেই থেমে গেল । সেই ব্যাপারেই কিছু বলবে বোধহয় লীলা ।

“কি ভাবছেন জিজ্ঞেস করল রানা থিরুকে।

“ভাবছি রঘুনাথ কিভাবে নেবে আজকের ঘটনাটা, বলল থিরু চিন্তিত মুখে।

‘আপনাদের একজন কাস্টোমার তো আমাকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছে।

আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম, পরে বুঝলাম বিশেষ ভয়ের কিছুই নেই । বিঘ্নরাজের মুখেই সমস্ত ঘটনা শুনতে পাবে রঘুনাথ । আর আসলে হাস্বানটোটার চাম্পিয়ানের পিছনেই টাকা ধরেছে সে এবার। বীরবর্ধনকে মারলে ওর বিশেষ কিছু যায় আসে না। যদি রঘুনাথ একে ব্যাক করত তাহলে আপনার পালানো ছাড়া উপায় ছিল না।”

‘বিঘ্নরাজটা আবার কে হলেন? ওই দৈত্যটার সাথের মোটা, টেকো লোকটা?”

‘হ্যা। বীরবর্ধন তো ওরই প্লেয়ার। বিগ্নরাজ লোকটা আসলে খারাপ না। মাঝে থেকে ওর কপালটা পুড়ল বলে খারাপই লাগছে আমার ।’

চা নিয়ে এল লীলা । থিরুর পাশের চেয়ারটায় ‘বসল। চা খেতে খেতে খানিকক্ষণ উসখুস করল থিরু তারপর জিজ্ঞেস করল, “কতদিন থাকবেন কান্ডিতে?

‘ভাবছি আগামীকাল উভা লাইনে বাদুলার ট্রেনে চাপব। শুনেছি এত সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীর আর কোন ট্রেন জার্নিতে দেখতে পাওয়া যায় না।’

“এখানে থেকে গেলে হয় না? মানে, আপনার তো আত্বীয়স্বজন কেউ নেই বলছিলেন, আধাআধি শেয়ারে আমাদের পার্টনার হয়ে যান না? আপনাকে লীলার আর আমার খুব ভাল লেগেছে । আপনার মত একজন লোক দরকার আমাদের…

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top