একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
বার্লিন আন্ডারওয়ার্ডে খবরটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। কুখ্যাত কয়েদী উলরিখ ডুয়েট জেল ভেঙে পালাতে গিয়ে পুলিসের হাতে ধরা গড়ে গেছে। খবরটা যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনি চাঞ্চল্যকর; তবে এর মধ্যে খানিকটা নির্দয় বিদ্রুপের প্রলেপ দেয়া কৌতুককর দিকও আছে।
খবরটা ভয়ঙ্কর এইজন্যে যে উলরিখ ডুয়েটের মত একজন অপরাধী স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনলে জার্মানীতে যত শিশুকন্যার মা-বাবা আছে তাদের দিনের কাজ আর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত। সারা দেশ থেকে মাত্র আড়াই বছরে পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সী একুশটা শিশুকন্যা চুরি করে মুক্তিপণ দাবি করেছে ডুয়েট, সতেরোটা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ও করেছে, অথচ রেপ করার পরে মেরে ফেলেছে নিষ্পাপ একুশজনকেই। ধরা পড়ার পর তার যখন বিচার চলছে, গোটা দেশের মানুষ ঘৃণায় সোচ্ছার হয়ে উঠেছিল, দাবী করেছিল আইন সংশোধন করে হলেও লোকটাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। এমনকি আন্ডারওয়ার্ডের জার্মান মাফিয়া ডনরাও নিজেদের মধ্যে আলাপ করার সময় মন্তব্য করেছিল, ডুয়েটের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করার পর সে-আইন বাতিল
করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ, ডুয়েটকে দুশো বিশ বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। কারাদণ্ডের মেয়াদ এত লম্বা হলেও, সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে ডুয়েটের আয়ু খুবই কম, তিন মাস পর সে তার ষাটতম জন্মদিন পালন করবার সুযোগও বোধহয় পাবে না, জেলখানার দুর্ধর্ষ কয়েদীরা পুণ্য অর্জনের লোভে বা স্রেফ ঘৃণাবশত মেরে ফেলবে তাকে ।
কিন্তু তাদের ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে এক জেলখানা থেকে আরেক জেলখানায় স্থানান্তরিত হয়ে বছর তিনেক হতে চলল বেঁচে আছে ডুয়েট।
অনেক দিন পর আবার তাকে বার্লিন-এর প্রধান কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। অন্যান্য জেলখানার মত এখানেও নিজের সম্ভাব্য খুনীকে চিনে ফেলতে চতুর ডুয়েটের কোন অসুবিধে হলো না। হাটাচলা বা খেলাধুলোর সময়টায় নিজেকে সবচেয়ে অরক্ষিত মনে হয়, তবে এই বিপজ্জনক সময়টাকেই সবচেয়ে ভালভাবে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারল সে । সবাই জানে শত জেরার মুখেও আদায় করা মুক্তিপণের টাকা কোথায় রেখেছে তা ফাঁস
করেনি ডুয়েট । পুরানো, হিংস্র আর শক্রভাবাপন্ন কয়েদীদের ওই লুকানো টাকার ভাগ দেয়ার লোভ দেখাল সে। তাতে একইসঙ্গে দুটো সমস্যার সমাধান হবার সম্ভাবনা । এক, টাকার লোভে কেউ তাকে খুন করবে না। দুই, ওই টাকার লোভেই কয়েদীরা তাকে জেল ভেঙে পালাতে সাহায্য করবে। অন্যান্য জেলখানায় কৌশলটা ফল দেয়নি, তারমানে এই নয় যে কয়েকশো বছরের প্রাচীন বার্লিন কারাগার ডুয়েটকে হতাশ করবে।
শহরের এক প্রান্তে ফাকা মাঠের মাঝখানে এটা আসলে প্রাচীন এক দুর্গ । রোমাঞ্চপ্রিয় সৌখিন লোকজন গ্যাস ভরা বেলুন নিয়ে আকাশে ওঠার জন্যে বহুদিন থেকে এই মাঠটাকে ব্যবহার করে আসছে।
দুর্গ অর্থাৎ কারাগারের পশ্চিম টাওয়ারের একটা সেলে একা থাকতে দেয়া হয়েছে ডুয়েটকে। তার সেলের উল্টোদিকে একটা ব্যালকনি, দিনের বেলা সেলের ভেতর থেকেও বিশাল মাঠটা দেখতে পাওয়া যায়। সেদিন রাতের বেলা মাঠটা ডুয়েট দেখতে পেল না, তবে কমলা আলোর আভা দেখে বুঝতে পারল ওখানে বেলুনে চড়ার আয়োজন চলছে।
দশ মিনিট পর রাতের খাবার দিয়ে গেল সশস্ত্র সেন্ট্রিরা। এটো বাসন-কোসন সব কাল সকালে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তারা। খেতে বসে চাবিটা ডুয়েট রুটির ভেতর পেল। তবে তালাটা সে তখনি খুলল না, খুলল আরও তিন ঘণ্টা পর, যখন দেখল কমলা আলো নিয়ে প্রকাণ্ড বেলুনটা দুর্গের মাথার কাছে উঠে এসেছে, ঝুলন্ত রশির সিঁড়িটা ব্যালকনির রেইলিং ছুঁতে যাচ্ছে।
তালা খুলে সেল থেকে বেরিয়ে রশির সিঁড়ি ধরে ঝুলে পড়তে মাত্র দশ সেকেন্ড লাগল ডুয়েটের।
দুর্গকে ছাড়িয়ে পিছন দিকের মাঠের মাথায় পৌছাল বেলুন। এই মাঠটাও বিশাল। রশির সিঁড়ি বেয়ে ইতোমধ্যে বেতের তৈরি রেইলিং ঘেরা বৃত্তাকার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে গেছে ডুয়েট। মোটা টাকার লোভে তাঁকে উদ্ধার করেছে জার্মান মাফিয়া ডন মেনহ্যাম জয়েস, তার দু’জন ভাড়াটে গুন্ডাকে বেলুনে সঙ্গী হিসেবে পেল সে। কিন্তু পালানোর এই অভিযান সব মিলিয়ে বিশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলো না। টাওয়ারের একজন কয়েদী পালাচ্ছে, এটা টের পেয়ে মাঠ ধরে বেলুনটার পিছু নিল এক ঝাঁক জীপ ও ভ্যান। প্রথমে ফাকা গুলি করে ভয় দেখাল কারারক্ষীরা, হ্যান্ডমাইকে আদেশ দিল বেলুন নিয়ে নিচে নামতে । জবাবে মেনহ্যাম জয়েসের গুন্ডারা পুলিসকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল। জেল সুপারের অনুমতি নিয়ে কারারক্ষীরা এবার রাইফেলের ট্ট্রিগার টিপে ফুটো করে দিল প্রকাণ্ড বেলুনটা।
সব মিলিয়ে দশটা গুলি করা হলো। ছ’টা গুলি খেলো দুই গুন্ডা। চারটে ফুটো নিয়ে অনেকটা অলস ভঙ্গিতেই মাঠে নেমে এলো বেলুন। কারারক্ষীরা ছুটে, এসে দেখল বেতের রেইলিং ঘেরা ক্যারিজে শুয়ে বুক চেপে ধরে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছে ডুয়েট । না, তার কোন গুলি লাগেনি । অভিনয়? হতেও পারে! কারারক্ষীরা কড়া প্রহরায় জেল হাসপাতালে নিয়ে গেল তাকে ঠিকই, তবে যথেষ্ট দেরি করে । ডাক্তার রোগীর অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ইসিজি করার নির্দেশ দিলেন। জানা গেল অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি ভুয়েটের হার্ট আ্যাটাক করেছে । তৎক্ষণাৎ কয়েকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে জরুরী টেস্ট করাবার পর ডাক্তার জানালেন, যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব বাইপাস সার্জারি দরকার। জেল হাসপাতালে একটাই অপারেশন থিয়েটার, তখন সেখানে অন্য এক রোগীর অপারেশন মাত্র শুরু হয়েছে, কাজেই ডুয়েটকে আ্যামবুলেন্সে তুলে পাঠিয়ে দেয়া হলো হোলি ফ্যামিলি হসপিটালে ।
পালাতে গিয়ে ডুয়েট পুলিসের গুলি খেয়ে আহত হয়নি, হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, বাঁচে কী মরে ঠিক নেই, খবরের এই অংশটা অনেকের মনেই নির্দয় কৌতুকের সৃস্টি করল। কেউ কেউ মন্তব্য করল, ঈশ্বর নিজে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই দুনিয়ার বুক থেকে তুলে নিতে যাচ্ছেন ওকে।
কে কী বলল সেটা বড়কথা নয়, তবে ডুয়েট কিন্তু সত্যি মারা গেল। হোলি ফ্যামিলির ইমার্জে্সী বিভাগের ডাক্তাররা রোগীকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, আর দশ মিনিট আগে এলে আমরা হয়তো শেষ একটা চেষ্টা করে দেখতে পারতাম।
ইমার্জেন্সীতে সারাক্ষণই রোগীর ভিড় লেগে থাকে । আজ যেন ভিড়টা অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই । আরও আছে এক ঝাঁক ডাক্তার, অ্যানিস্থেটিস্ট, নার্স, ওয়ার্ডবয়, লাশ নিতে আসা মর্গের লোকজন । সবাই খুব ব্যস্ত। ডাক্তাররা শুধু যে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তা নয়, হাতের কাজ থামিয়ে ডেথ সার্টিফিকেটও লিখতে হচ্ছে। এতসব লোকের ভিড়ে সুযোগের সন্ধানে রয়েছে পাঁচজন লোক। তারা একটা লাশ চুরি করবে। পাঁচজনই ছদ্মবেশ নিয়ে আছে-একজন সেজছে ডাক্তার, দু’জন ওয়ার্ডবয়, দু’জন নার্স। শুধু ছন্দবেশ নিয়ে আসেনি, সঙ্গে করে একটা আ্যামবুলেন্সও নিয়ে এসেছে। ছদ্মবেশ বা আমবুলেন্স দেখে কারও বলবার সাধ্য নেই যে এগুলো হোলি ফ্যামিলি হসপিটালের নয়।
এই পাঁচজন বার্লিন আন্ডারওয়াল্ডের তরুণ মাফিয়া ডন ওয়াজটেক হেলম্যানের একটা দক্ষ টীম। “এক কথার মানুষ” খ্যাতি নিয়ে দ্রুত উত্থান ঘটেছে হেলম্যানের। পরিচয় গোপন রেখে এক লোক একটা লাশ চেয়েছে তার কাছে। বিনিময়ে অবিশ্বাস্য মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হবে, চাইলে এমনকী নগদ মার্কিন ডলারে । তবে কয়েকটা শর্ত আছে। যেমন-কাউকে খুন করে লাশ যোগাড় করা যাবে না, লাশ হতে হবে অক্ষত, বয়স হতে হবে ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে, সাড়ে পাঁচফুটের বেশি লম্বা হওয়া চলবে না, স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল হওয়া চাই ইত্যাদি । কাজে নেমে দেখা গেল যত সহজ মনে করা হয়েছিল শর্তগুলোর কারণে কাজটা ততটা সহজ নয়। অবশেষে একাধিক ক্লিনিক আর হাসপাতালে আলাদা আলাদা টাম পাঠাল হেলম্যান। সেগুলোর মধ্যে সফল হলো হোলি ফ্যমিলির টীমটা । কীভাবে?
উলরিখ ডুয়েট মারা গেছে, ডাক্তারেরা এ-কথা ঘোষণা করার পর ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ভিতর কারারক্ষীদের আর থাকার কোন প্রয়োজন রইল না, কাজে অসুবিধে হওয়ায় নার্স আর ওয়ার্ড বয়রা তাদেরকে থাকতে দিলও না। ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের বাইরে, ওয়েটিং রূমে বসে অপেক্ষায় থাকল তারা কখন ডেথ সার্টিফিকেট সহ ডুয়েটের লাশ ফিরে পাবে। ইমার্জেন্সিতে অনেক লাশই রয়েছে, ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে দেরি হওয়ায় বা ওয়ার্ড বয়ের অভাবে
বের করা যাচ্ছে না। হেলম্যানের টীম জানালা দিয়ে লক্ষ করল, সদ্য মৃত এক তরুণের ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হলেও, ওয়ার্ড বয়ের অভাবে লাশটা কামরা থেকে বের করা হচ্ছে না। সংশিষ্ট ডাক্তার নিজের লেখা ডেথ সার্টিফিকেটটা বেডের গায়ে ঝুলন্ত বোর্ডে পিন দিয়ে আটকে অন্য এক রোগীর জরুরী চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন । পাঁচ ছদ্মবেশী এই সুযোগটাই দ্রুত কাজে লাগাল । কামরায় ঢুকে বোর্ডসহ ডেথ সার্টিফিকেট মৃত ডুয়েটের বেডে ঝুলিয়ে দিল। তারপর চাদর দিয়ে লাশ ঢেকে চাকা লাগানো বেডটা নিয়ে বেরিয়ে এলো করিডরে-ছুটছে পাঁচজনই, যেন মুমূষু একজন রোগীকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টার কোন ক্রটি করছে না। কারারক্ষীরা কিছু টেরই পেল না, তাদের সামনে দিয়ে ডুয়েটের লাশ নিয়ে চলে গেল হেলম্যানের টীম ।
নির্জন এক রাস্তায় আমবুলেন্স থেকে একটা মাইক্রোবাসে তুলে দেয়া হলো ডুয়েটের লাশ। টাকা-পয়সার লেনদেনও রাস্তায় দাড়িয়ে সারা হলো । আগেই বলে দেয়া হয়েছে, মাইক্রোবাসটাকে হেলম্যানের লোকজন ফলো করতে পারবে না।
ডুয়েটকে নিয়ে মাইক্রোবাস পৌছাল একজন ডেন্টিস্ট-এর চেম্বারে । ডেন্টিস্ট ভদ্রলোক – আগে থেকেই তৈরি ছিলেন।
যন্ত্রপাতির সাহায্যে লাশটার সবগুলো দাঁত একটা একটা করে তুলে ফেললেন তিনি। সব দাত তোলার পর নকল দুই প্রস্থ দাত লাশের মাড়িতে বসিয়ে দিলেন। এগুলো নকল দাত হলেও তা অবশ্য সহজে বোঝার কোন উপায় নেই। তাছাড়া তিনি যে নতুন ধরনের গ্লু বা আঠা ব্যবহার করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে ঘা মারলে দাতগুলোকে ভাঙ্গা যাবে, কিন্তু মাড়ি থেকে আলগা করা যাবে না।
উলরিখ ডুয়েট বেঁচে নেই, থাকলে দেখতে পেত ডেন্টিস্ট ভদ্রলোকের চেম্বারে প্রায় টেকি আকৃতির অত্যাধুনিক একটা ডীপ ফ্রিজার রয়েছে।
সেন্ট্রাল জেল থেকে ডুয়েটের পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার খবরটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল। হলি ফ্যামিলি হস্পিটালের ইমারজেন্সী থেকে তার দ্বিতীয়বার পালানোর খবরটা সাইক্লোনের মত শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ল । ডুয়েট মারা গেছে? নাহ, পুলিস এ-কথা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। মারা গিয়ে থাকলে লাশ কোথায়? ডেথ সার্টিফিকেটই বা নেই কেন? লাশ চুরি গেছে? দূর-দূর, এরচেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে না। ডুয়েটের মত কুখ্যাত একজন নরপিশাচের লাশ কী উদ্দেশে কারা চুরি করতে যাবে! না, ডুয়েট বেঁচে আছে। হার্ট অ্যাটাক হয় তার অভিনয় ছিল, কিংবা ধাক্কাটা একটু সামলে নেয়ার পর সুযোগ পেয়ে পালিয়েছে। সারা দেশের
পুলিসকে সতর্ক করে দেয়া হলো, ডুয়েটকে ধরো । সীমান্তে শুরু হলো কড়া চেকিং, ভয়ঙ্কর লোকটা যাতে জার্মানী ছেড়ে পালাতে না পারে।
দুই
বার্লিন থেকে শুরু হতে যাচ্ছে মাউন্ট অলিম্পাস মোটর র্যালি। হোমস্টাড উলজেন পার্কের ভেতর চলছে ফর্মুলা রেসিং কার ড্রাইভারদের প্র্যাকটিস। প্রকাণ্ড আকারের এক ঝাঁক ট্র্যান্সপোর্টার প্রতিযোগী কোম্পানির কারগুলো বয়ে নিয়ে এসেছে, এখন সার বেধে দাড়িয়ে আছে পিটগুলোর পিছনে । চারদিকে পেট্রল ট্যাংকার, ফায়ার টেন্ডার, অ্যাকসেসারিজ ম্যানুফ্যাকচারার আর টায়ার কোম্পানির পাঠানো ভেহিকেলের ছড়াছড়ি-সবগুলো চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল রঙ করা-যেন একটা বিশৃঙ্খল কার্নিভাল শুরু হতে যাচ্ছে। এই সব যন্ত্রদানব আর হেলমেট পরা ফর্মুলা রেসিং
কার-ড্রাইভারদের ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাসুদ রানা ।
দু’একবার নয়, ফর্মুলা ওয়ান গ্রা প্রি-তে ছয়বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে ও, তবে সে অনেকদিন আগের কথা । অবশ্য যদি কোন রেস বা র্যালিতে অংশ নেয়, ও-ই হবে প্রথম, এই আত্মবিশ্বাস আজও ওর চেতনায় অটুট রয়েছে।
বার্লিনে রানা ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে এসেছে। তবে এটাকে ঠিক অফিশিয়াল কাজ বোধহয় বলা চলে না। বিসিআই চীফ রাহাত খানের ব্যক্তিগত বন্ধু কার্ল ব্রেডিয়াস মারা গেছেন, শোক ও সহানুভূতি জানিয়ে লেখা একটা চিঠি তার স্ত্রীর হাতে পৌছে দিতে হবে। রাহাত খানের প্রতিনিধি হিসেবে কার্ল ব্রেডিয়াসের কবরে ফুলের একটা তোড়াও রেখে আসতে হবে রানাকে ।
কিভাবে কী করতে হবে টেলিফোনে সব যখন বুঝিয়ে দিচ্ছেন বস্, রানা তখন মনে মনে “শালা বুড়োকে ভীমরতিতে ধরেছে’ বলে গাল দিচ্ছে, ভাবছে-একটা কাজ সেরে সুইটজারল্যান্ডে এসেছি দু’দিন বিশ্রাম নিতে, অথচ উনি আমাকে পিয়নের কাজ দিয়ে বার্লিনে পাঠাচ্ছেন! তখনও রানা জানে না কে মারা গেছেন, ভদ্রলোকের পরিচয় দিলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান। লজ্জায়, নিজের ওপর রাগে, প্রায় অসহায় বোধ করল রানা । কার্ল ব্রেডিয়াস মারা গেছেন, এটা ওর জন্যেও একটা দুঃসংবাদ । ভদ্রলোক জার্মান ইন্টেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর ছিলেন। শুধু রাহাত খানের বন্ধু নন, বিসিআই-এর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে তার ছদ্মনাম ছিল ব্র্যান্ট নজল্।
শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্বটা পালন করল রানা । ফাউলিন ব্রেডিয়াসের হাতে রাহাত খানের চিঠিটা পৌছে দিল। তাজা ফুলের দুটো তোড়া কিনে সযত্নে রেখে এলো তার স্বামীর কবরে। কাজ শেষ, কিন্তু মনটা বিষন্ন, আবার প্লেন ধরে সুইটজারল্যান্ডে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না-যদিও মিষ্টি এক সুইস তরুণী কলে রেখেছে, তুমি ফিরলেই তোমাকে নিয়ে আল্লপসের ঢালে স্কীইং করতে যাব ।
তারপর মনে পড়ল ক’দিন পর বার্লিন থেকে শুরু হতে যাচ্ছে মাউন্ট অলিম্পাস মোটর কার র্যালি। বিখ্যাত সব ড্রাইভাররা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে, জানা কথা; তবে রানা একসময় যাদেরকে বিখ্যাত হিসেবে চিনত তারা নিশ্চয়ই নয়। নতুনদেরকে পথ ছেড়ে দিয়ে পুরানোদেরকে সরে যেতে হয়, প্রকৃতিরই বিধান অনুসারে কে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে । তবু একটা অমোঘ আকর্ষণ কৌতুহলী করে তুলল ওকে। পরিচিত কারও সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়! ওরই মত কেউ যদি হঠাৎ চলে আসে পথ ভুলে?
যাকে সাংবাদিক হিসেবে চিনত রানা, সেই জেমস মিচেল মারা গেছেন। উনি আসলে ইন্টারপোলে ছিলেন, নারকোটিক্স সেকশনের চীফ । রানার ছোটবোন সেই জুলিয়া কোথায়, কোন খবর নেই। হ্যানসিঙ্গার আর ব্রনসন তো খাদে পড়ে মারাই গেল-ওদেরকে রানাই ফেলে দেয়। ওদের দু’জনের মত মার্কাস কাপলানও ছিল হেরোইন-এর ডিস্ট্রিবিউটর। আমস্টারডামে গ্রেফতার হয় সে। আদালতে মামলা শুরু হলে আশ্চর্য সব তথ্য বেরিয়ে আসে। কাপলান আসলে জার্মান, তবে পুরোপুরি নয়-তার শরীরে ইরাকী রক্ত বইছে, অর্থাৎ তার মা ছিলেন একজন ইরাকী। মার্কাস কাপলান ছাড়াও তার আরেকটা নাম ছিল-আসল নাম, মাহরূফ কামরান। তবে দেখতে সে পুরোপুরি
একজন জার্মান। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মার্কাস কাপলান ওরফে মাহরূফ কামরান অকাট্য ভাবে প্রমাণ করে যে সে আসলে ব্ল্যাকমেইলিঙের শিকার হয়ে হ্যানসিঙ্গার আর ব্রনসনের সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হয়েছিল। যাই হোক, বহুদিন তারও কোন খবর রাখা হয়নি। রানা শুধু শুনেছে, ওর পর তিনটে গ্রা প্রি-তে কাপলানই চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল! হবারই কথা, ও থাকতে সে-ই তো প্রতিবার দ্বিতীয় হত।”
বিভিন্ন কোম্পানির পিটে একবার করে ঢুঁ মারল রানা ।
পরিচিত কাউকে দেখছে না কোথাও । মেকানিকদের জন্যে পোর্টেবল বার আছে, তার একটায় ঢুকল। টুলে বসে বিয়ার নিয়েছে, চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে কে যায় কে আসে ।
দশ মিনিট পর কাউন্টারে কয়েকটা মার্ক রেখে টুল ছাড়ল, গ্লাস ভর্তি বিয়ার ছুয়েও দেখেনি । বার থেকে বেরিয়ে আসছে রানা, পিছনে দ্রুত খটখট আওয়াজ হলো । তারপর হাত পড়ল কাধে । “মরিস? মরিস রেনার?’
স্থির হয়ে গেল রানা। ওর এই ইটালিয়ান নাম তো শুধু একবারই ব্যবহার করা হয়েছে-অনেকদিন আগের কয়েকটা গ্রা
প্রিতে। তারমানে ওর আশা পুরণ হয়েছে! সে সময়কার কেউ একজন ওরই মত পথ ভুলে চলে এসেছে এখানে, মাউন্ট
অলিম্পাস র্যালির প্রস্তুতি দেখতে ৷ নাকি অংশ নিতে? কিন্ত গলার আওয়াজটা ঠিক চিনতে পারা যাচ্ছে না । ধীরে ধীরে ঘুরল রানা ।
এবং লোকটাকে ও চিনতে পারল না।
প্রথমেই চোখে পড়ল বাম বগলের নিচে একটা ক্রাচ। খয়েরি-সোনালি চুল মেয়েদের মত লম্বা, অযত্নে প্রায় জট পাকিয়ে গেছে; মুখে দাড়ি-গোফের জঙ্গল। চোখদুটো গর্তে বসা, তারমধ্যে একটার ভেতর নীলচে কাঁচ। অক্ষত চোখের দৃষ্টিতে হতাশা আর ক্রান্তি। “কে আপনি?’ বিড়বিড় করল রানা । “আমার নাম জানলেন কীভাবে?
হেসে উঠল লোকটা, বগলে ভাল করে ক্রাচ্টা আটকে এক পায়ে একটু লাফিয়ে খানিকটা সামনে বাড়ল, তারপর রানার একটা বাহু খামচে ধরল, “ঠাট্টা করছ, তাই না? নাকি মার্কাস কাপলানকে আজও ক্ষমা করতে পারোনি বলে চিনতে না পারার ভান করছ?
“কে? এইবার বিষম এক ধাক্কা খেলো রানা । “বল কি!
“তুমি –কাপলান?
মুখে বিষন্ন এক চিলতে হাসি নিয়ে চুপ করে থাকল লোকটা ।
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।