একটু চোখ বুলিয়ে নিন
১
শাহবাড়ির পাহাড়ের গোড়ায় পৌছে আহমদ মুসা ভাবল, মসৃণ রাস্তা ধরে সে গাড়ি নিয়ে শাহবাড়িতে উঠে যেতে পারে। কিন্তু উঠতে গিয়ে মনের তরফ থেকে বাধা পেল আহমদ মুসা।
সুতরাং ওঠা বাদ দিয়ে আহমদ মুসা পাহাড় ঘুরে শাহবাড়ির পেছনে চলে এল এবং প্রথমবারের মত এবারও পাহাড় বেয়ে ক্রলিং করে শাহবাড়ির পেছনের সংকীর্ণ একটা চত্বরে উঠে এল।
একটা ছোট গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল আহমদ মুসা। তারপর বাড়ির দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে লাগল। ইতিমধ্যেই কেউ এসেছে কিনা, তার অনেক খানি বোঝা যাবে সামনের দিকটা দেখলে।
বাড়ির সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। আহমদ মুসা দেয়ালের যে বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা পার হলেই গাড়ি বারান্দা দেখা যাবে।
আহমদ মুসা সোজাসুজি বাঁকটা পার না হয়ে গাড়ি বারান্দা দেখার জন্যে উঁকি দিল। দেখতে পেল গাড়ি বারান্দা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি গাড়ি। দুটি মাইক্রো এবং একটি জীপ।
বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে। এতগুলো গাড়ি নিয়ে কারা এল? ব্ল্যাক ঈগলের লোকরা কি? তাদের আসাই স্বাভাবিক। ভোর পর্যন্ত তাদের লোকরা যয়নব যোবায়দাকে ধরে নিয়ে না ফেরায় এবং সম্ভবত যোগাযোগেও ব্যর্থ হওয়ায় খারাপ কোন কিছু ঘটার আশংকায় তারা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে বুঝল গাড়িতে কোন লোক নেই। যারা এসেছে নিশ্চয় সবাই ভেতরে ঢুকেছে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
বাহিরটা আরেকবার দেখে ভেতরে ওদের উপর চোখ রাখার সিদ্ধান্ত নিল।
ভেতরে ঢোকার দরজা খোলা পাবে ভেবেছিল। খোলাই পেল।
ধীরে ধীরে ঘরের দরজা খুলল। দিন হলেও ভেতরটা অন্ধকার দেখল। ভেতরটা সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করতে চাইল আহমদ মুসা।
কিন্তু দরজা খুলে স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই ছুটে আসা একটা কিছু তার উপর পড়ল। এর নরম স্পর্শ পাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার অভিজ্ঞ অনুভূতি নিশ্চিত হলো কি ঘটতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল বর্তমান সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভয়ংকর নরম ধাতব ফাঁস তাকে এসে ঘিরে ধরেছে।
ফাঁস আহমদ মুসাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই চোখের পলকে আহমদ মুসা বসে পড়ল। ঠিক যেমন মায়ের পেটে শিশু দুই হাঁটু, দুই হাত এবং মাথা এক সন্ধিস্থলে নিয়ে অবস্থান করে। এর ফলে নরম ধাতব ফাঁস প্রত্যেক অংগকে আলাদা করে আটকে ফেলে মানুষকে একেবারে নিস্ক্রিয় করে ফেলার যে কাজ করে তা করতে পারল না।
ফাঁদ তার বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিক্ষিপ্ত হবার পর গুটিয়ে গিয়ে আহমদ মুসাকে রাগবি বলের মত রূপ দিল।
ফাঁদ যে ছুঁড়েছিল সম্ভবত সেই লোকটিই চিৎকার করে উঠল, ‘শিকার ধরে পড়েছে।’
সংগে সংগেই ছুটে এল কয়েকজন লোক। তারা ফাঁদ ধরে টেনে-হিঁচড়ে আহমদ মুসাকে ভেতরে এক তলার দরবার কক্ষে নিয়ে গেল।
আহমদ মুসা ফাঁদের মধ্যে তার দেহকে যেভাবে গুটিয়ে নিয়েছিল, তাতে তার দেহ হয় ডান ও বাম দিকে কাত হয়ে, নয়তো চিৎ হয়ে থাকছে।
দরবার কক্ষে যখন তাকে আছড়ে ফেলল তখন তার দেহটা কাত হয়ে পড়ল। একজন তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘লাদিনো বস, হোটেল থেকে এরই ফটো পাওয়া গেছে। তার মানে এই সেদিন মেলার মাঠে আমাদের চারজন লোককে হত্যা করেছে।’ বলেই আহমদ মুসাকে কষে কয়েকটা লাথি লাগাল।
লাদিনো ব্ল্যাক ঈগলের এই দলের প্রধান। এরাই সকালে পাত্তানী সিটি থেকে শাহবাড়ি এসেছে তাদের লাপাত্তা হওয়া সাথীদের খোঁজে।
লাদিনো ছুটে এল তার সাথীর কথা শুনে। আহমদ মুসার কাছে এসে আহমদ মুসার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল। দেখে সেও চিৎকার করে উঠল, ‘ঠিক, কোন সন্দেহ নেই এই শয়তানই সেই শয়তান।’
বলে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম দিল, ‘একে ঝাড় বাতির হুকের সাথে টাঙাও। তারপর পেটাও। আজ আমাদের ৮ জন লোক গায়েব হওয়ার খবরও এই শয়তান দিতে পারবে। আমি নিশ্চিত, ঐ শয়তান আর এই শয়তান দু’জনেই আজ রাতে এখানে ছিল। যয়নবরা কোথায় এ কথাও এরাই বলতে পারবে।’
আহমদ মুসাকে টাক্সিয়ে দেয়া হয়েছে ছাদের ঝাড়বাতির হুকের সাথে। ফাঁসের গোড়াটাকে বাঁধা হয়েছে হুকের সাথে। ফাঁসের পেটে ঝুলছে আহমদ মুসা মাটি থেকে দুই ফিট উপরে।
আহমদ মুসার গুটানো দেহটা এবার ফাঁদে উপুড় হয়ে আছে। মেঝের বড় অংশই সে এখন দেখতে পাচ্ছে।
মেঝের উপর পড়ে থাকা একটা রক্তাক্ত যুবকের দেহ তার নজরে পড়ল। তেইশ চবিবশের মত বয়স হবে যুবকটির। বুঝাই যাচ্ছে তাকে নির্মমভাবে মেরেছে। আহত স্থানগুলো থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সম্ভবত ছেলেটিকেও সকালে এখানে ধরা হয়েছে। কিন্তু ছেলেটি কে? এখানে এসেছিল কেন?
লাদিনো নামের লোকটি এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। তার হাতে কালো রঙের একটি ব্যাটন। বুঝাই যাচ্ছে, শাল কাঠের ব্যাটনটি লোহার মত ভারী হবে। ব্যাটনের উপর পেরেক বসানো। পেরেকগুলো সিকি ইঞ্চির মত লম্বা। পেরেকের মাথাগুলো তীক্ষ্ণ নয়, ভোঁতা ধরনের। এ ধরনের কাঁটাওয়ালা ব্যাটন বেয়াড়া মানুষকে কথা বলাবার জন্যে নাকি খুবই উপকারী।
লাদিনো ব্যাটনটি দিয়ে ফাঁসে আবদ্ধ ঝুলন্ত আহমদ মুসাকে একটা প্রচন্ড আঘাত করে বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা, ঐ দিকে দেখ কথা বলায় কি হাল হয়েছে। আমরা জানতে চাই গত রাতে তুই এ বাড়িতে এসেছিলি কি-না, আমাদের ৮ জন লোক কোথায় গেল এবং কোথায় গেল এ বাড়ির লোকরা?’