বুমেরাং – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Bumerang – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

কালো নতুন গোঁফ বেশ ভালই গজাতে শুরু করেছে। পুরো এক হপ্তার সবটুকু আগুনে রোদ দিয়ে পুড়িয়ে নিয়েছে চামড়া, বিশ্রামহীন পথচলা আর বিরতিহীন সতর্কতা চেহারায় এনে দিয়েছে রুক্ষ-কঠোর একটা চন্ডাল ভাব। শুধু চোখ জোড়া শ্বাপদের মত ঠাণ্ডা, যেন ওগুলোর পিছনে মগজ কোন কাজ করছে না। টেক্সাসের ওপর দিয়ে আসার সময় সাদা কনভার্টিবল-এর ছাত নামিয়ে দিয়েছিল সে। ভেবেছিল বাতাস পেলে রোদ একটু সহনীয় হবে । আরও একটা কারণ ছিল। যে লোক উন্মোক্ত গাড়িতে থাকে তার ওপর হঠাৎ কারও নজর পড়ে না। টেক্সাসে ভয়ে ভয়ে ছিল সে। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর বিপদের ভয়টা কমে আসে, তবে রোদ হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গের জ্বলন, কাজেই এবার সে রাস্তার পাশে ধুলোর মধ্যে গাড়ি থামিয়ে ছাত তুলে মাথা ঢাকে । তোবড়ানো পানামা হ্যাটটা খুলে নামিয়ে রাখে সীটের পাশে, কিনারার ঘামটুকু শুকিয়ে যাক। ছোট্র একটা ধন্যবাদ দিল সে নিজেকে, স্ট্র হ্যাটের বদলে মনে করে
পানামাটা এনেছিল ‘বলে। শত্রপক্ষ কোন আমেরিকানকে খুঁজছে না, যদিও জানে একজন আমেরিকানের ছদ্মবেশ নিয়েই পালাচ্ছে সে।
আঙুলের ডগা দিয়ে নতুন গোফ জোড়ার স্পর্শ নিল সে। রিয়ার ভিউ মিররে চোখ । মুচকি হাসল একটু।
শহরের অনেক ওপরে পাহাড়শ্রেণীর চুড়া গুলো আকাবাকা রেখা টেনেছে আকাশের গায়ে, রোদ লেগে লালচে কুয়াশার মত লাগছে দেখতে । মনে আশা শীতল আশ্রয় মিলবে ওখানে, ভদ্র একটা হোটেল খুঁজে নিতে পারবে
সে, যদি থাকে ।
গির্জাটা প্লাজা সিভিকার মাথায়। রাস্তা পেরিয়ে খানিক দূর এগোতেই পাওয়া গেল হোটেল ডিসেম্বর । লাল ইটের বিল্ডিং, আইন-শৃষ্লা পরিস্থিতির জাজ্ল্যমান সাক্ষ্য দিচ্ছে সর্বাঙ্গে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে।
হোটেলের সামনে শেভ্রোলে কনভার্টিবল থামাল সে, আগেই দেখেছে পার্ক থেকে কয়েক জোড়া চোখ লক্ষ করছে তাকে। কে জানে, হয়তো ওপরের জানালা গুলো থেকেও । তবে কি এদিককার বেশিরভাগ লোকের মত তারও সাদার বদলে কালো গাড়ি ব্যবহার করা উচিত ছিল? গাড়িটা পুরানো মডেলের, কিন্তু এরইমধ্যে তার মন জয় করে নিয়েছে! ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে ওটার চকচকে ভাব, কিন্তু জানে একবার হাত পড়লেই ঝলমলে হাসি উপহার দেবে তাকে । শুনলে লোকে পাগল ভাববে, কিন্তু কথাটা সত্যি, এই কয়দিনেই গাড়িটার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার।

জ্যাকেটটা পরে নিল আগন্তক, হাতে নিল একটা মাত্র সুটকেস। বাকি সব গাড়ির ট্রাঙ্কের মধ্যে নিরাপদে আছে। হোটেলের সামনে বেঞ্চে বসা বুড়ো লোকটাকে দেখল, কিন্তু পাত্তা দিল না। তিন আঙুলের ভেতর আড়াল করে ধরা সিগারেট টানছে, সম্ভবত এইমাত্র কারও ফেলে যাওয়াটা কুড়িয়ে নিয়েছে।

তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, বুড়ো মাথা ঝাকিয়ে বলল, হাই! যেন কতকালের পরিচিত। দাঁড়াল সে। নোংরা, ভাজহীন স্যুট পরা বুড়োকে আগে কখনও দেখেনি, নাকি দেখেছে কিন্তু চিনতে পারছে না? তীক্ষ্ণ, কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল আগন্তক। বুড়োর চেহারায় কঠিন পরিশ্রমের ছাপ। চোখ দুটো দীন পোশাক আর কর্কশ অবয়বের সাথে একেবারেই বেমানান । দৃষ্টিতে কৌতুক আর সারল্য মিলেমিশে আছে। মুখটা চওড়া, তবে হাড় বেরুনো, নাক আর চোখ
বাদে গোটা মুখই ঢাকা পড়ে আছে আধ ইঞ্চি লম্বা কাচা-পাকা দাড়িতে ।

স্প্যানিশ ভাষা জানে সে, কিন্তু এদিকে আঞ্চলিক ভাষারই একচেটিয়া চল। হাই বলেই বুড়ো থামেনি, তাকে দাঁড়াতে দেখে যোগ করল; “এক-আধটা ডলার হবে নাকি, সিনর?’

সুটকেসটা নামাল সে । তুমি জানলে কিভাবে আমি ইংরেজী বুঝব?

“আপনার হাটা, সিনর। মাটিতে পা আমরা সবাই ফেলি, কিন্তু সুন্দর আর মার্জিত হয় ক’জনের? তাছাড়া, ও-ধরনের ফ্যান্সি জিনিস এখানে কেউ চালায় না।” সাদা কনভার্টিবলের দিকে ইঙ্গিত করল বুড়ো। “একটা ডলার যদি
হাতছাড়া করেন, ওটার ওপর নজর রাখব আমি ।’

আপনি হোটেলে ঢোকার তিন সেকেন্ডের মধ্যে ছোকরারা ওটাকে ছেঁকে ধরবে । আমার পকেট খালি, একটা ডলার পেলে কাউকে ধারেকাছে ঘেষতে দেব না।’ হাসল বুড়ো।

মানিব্যাগ বের করে বুড়োর হাতে পাচ ডলারের একটা নোট গুজে দিল আগন্তক | “ধরে নেব কাজটা ঠিকমত করবে, ঠিক তো?

নোটটা ভাল করে দেখল বুড়ো, জাল কিনা পরীক্ষা করছে। হঠাৎ জিতেছে । ‘থ্যাঙ্ক ইউ,’ বলল সে, শেষ শব্দটা টেনে লম্বা করল।

আবার সুটকেসটা তুলছে আগন্তুক, শুনতে পেল বুড়ো বলছে, “আপনাকে আমি আগে কখনও দেখেছি নাকি, সিনর? লারেডোতে ছিলেন কখনও?,

“না ।’ আগন্তুকের পেশীতে টান পড়ল।

‘সান আন্তনয়ে?’

“না” বলল সে, ধাপ বেয়ে উঠে যাচ্ছে হোটেলের দিকে।

“সিনর, আমি জানি আপনি কার মত দেখতে -.”, পিছন থেকে চেচিয়ে বলল বুড়ো ।

সিঁড়ির দুই ধাপে দুই পা পাথর হয়ে গেল আগন্তুক । ধীরেধীরে ঘুরল সে, নেমে এল। দ্রুত একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে এরইমধ্যে দেখে নিয়েছে আশপাশে কেউ আছে কিনা । রাস্তার ওপারে আপনমনে হেটে যাচ্ছে মোটা এক মেক্সিকান মহিলা, তাছাড়া শুনতে পাবার মত কাছাকাছি আর কেউ নেই। তবু বুড়োর কাছে ফিরে এল সে, কিন্তু কথা না বলে অপেক্ষা করতে লাগল।

বুড়োর চেহারায় ঠিক ভয় নয়, কেমন যেন ইতস্তত ভাব আর সংশয়। আগন্তকের শীতল দৃষ্টির সামনে অস্বস্তিবোধ করতে লাগল সে । আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, ফটো দেখেছি কিনা…এদিকে এক লোক এসে কয়েকজনকে দেখিয়ে গেছে! আপনি ঠিক সেই ফটোর লোকটার মত দেখতে, সিনর?, মাসুদ রানা-হ্যা, ঠিক তার মত। আপনি সে-ই লোকই নন তো, সিনর?

চক্কর দিয়ে উঠল রানার মাথা । এখানে, এতদূরেও ওর ফটো পাঠিয়েছে হার্মিস? “তুমি ভুল করছ, ফ্রেন্ড । আমার নাম রড–পিটার রড ।” জ্যাকেট একটু ফাক করল ও, বুড়ো যাতে কোল্ট পিস্তলের বাটটা দেখতে পায়-ওর বাম বগলের নিচে হোলস্টারে রয়েছে । “তবু বলি, তোমার সাবধান হওয়া উচিত, ওল্ড টাইমার। জায়গা বুঝে জোট বাধতে হয়, তাই না? তুমিও বিদেশী, আমিও বিদেশী, অন্যান্য মিল থাক বা না থাক,কি বলো?

জ্বী, সিনর, ঠিক বলেছেন-আমার বোধহয় ভুলই হয়েছে । সত্যি দুঃখিত।’

“অমন দু’একটা ভুল আমি নিজেও রোজ করছি, বলে হোটেলে ঢুকে পড়ল রানা । জানতে হবে এদিকে কে কে তার ফটো দেখেছে, তবে এখুনি কৌতুহলী হলে বুড়োর মনে যে-টুকু সংশয় আছে তাও আর থাকবে না, নিশ্চিতভাবে ধরে নেবে সে-ই মাসুদ রানা । ডিসেম্বরের সামনের একটা ঝুল-বারান্দায় বসে ওদের কথাবার্তা শুনল লোকটা । সবটুকু না হলেও, যতটুকু শুনেছে, তার মত লোকের মাথায় কৃবুদ্ধি গজানোর জন্যে তা যথেষ্ট । ঝুল-বারান্দার কিনারায় নয়, রোদ এড়াবার জন্যে দেয়াল ঘেঁসে বসেছে সে। বারান্দা সহ তিন কামরার সুইট, প্রায় সারা বছর রিজার্ভ থাকে তার জন্যে । আগন্তকের শুধু হাটা নয়, হাবভাব আর কথাবাতাও আকৃষ্ট করেছে তাকে, সব মিলিয়ে যেন ব্যক্তিত্ব আর কর্তৃত্বের উৎকৃষ্ট নমুনা প্রত্যক্ষ করন সে। মালাক্কা ছড়িটা নিয়ে চেয়ার ছাড়ল, সিধে হয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল, নিচের লবিতে নামবে । চেহারায় আত্মবিশ্বাস, বড়বড় চোখে ধূর্ত দৃষ্টি, জানে লোক চিনতে তার ভুল হয় না।

ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে চাবির জন্য অপেক্ষা করছে রানা, আয়নায় চোখ পড়তেই দেখতে পেল লোকটাকে । দীর্ঘদেহী, চওড়া নিরেট কাধ, শুধু কপালের ওপর ইঞ্চিখানেক সোনালি চুল, ফিতের মত ঘিরে আছে মাথাটাকে, লম্বাটে ভরাট মুখে ভাঙা নাকটা ভারি বেমানান। স্বচ্ছন্দভঙ্গিতে হেটে আসছে সে, মনেই হয় না কোন বোঝা বহন করছে, অথচ ওজন হবে আড়াই কি পৌনে তিন মণ। হাতের ছড়িটা মেঝেতে ঠোকার মধ্যে নৃত্যের একটা ছন্দ আছে, আভিজাত্যের পরিচয়বাহী । মাথা উচু করে আসছে সে, গর্বে যেন মাটিতে পা পড়ে না। ডেস্ক ক্লার্ক রানাকে তেমন গ্রাহ্য করেনি, কিন্ত লবিতে লোকটাকে দেখেই সটান দাড়িয়ে পড়ল, হাত কচলাচ্ছে।

লম্বা চুরুটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে রানার দিকে পিস্তলের মত তাক করল লোকটা । “সিনর রড? সবিনয় ভদ্রতার সাথে, নির্ভুল উচ্চারণে, ইংরেজীতে প্রশ্ন করল সে।

স্থির হয়ে গেল রানা। ওর পাসপোর্টের নাম জানল কিভাবে লোকটা? অস্বীকার করে লাভ নেই। ডেস্ক ক্লার্ক জানে, জানে বাইরে বসা বুড়োটা। হ্যাঁ।

‘পরিচয় ঘোষণার সুযোগ দিন আমাকে, প্লীজ, সিনর। ডন হোসে স্যামুয়েল দ্য হোমায়রা।’

দু’জন ওয়েটারকে পিছনে নিয়ে লবিতে ঢুকল হোটেল ম্যানেজার, হোমায়রাকে দেখে তিনজনই তারা কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল। দয়া করে মুচকি একটু হাসল হোমায়রা, হাত নেড়ে তফাতে থাকার নির্দেশ দিল সে। সন্দেহ নেই, ভাবল রানা, এদিকের চাকাগুলো এই লোকই ঘোরায়।

আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল সিনর, রানার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল হোমায়রা, ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে ঠোটে । “কথা দিচ্ছি আপনার কোন ক্ষতি হবে না।’

ক্ষতি?’ ঘাড় ফিরিয়ে লোকটার দিকে সরাসরি তাকাল রানা ।

“সম্ভবত আপনার সাথে আপনার কামরায় যেতে পারি আমি, সিনর?’ পাল্টা প্রশ্ন করল হোমায়রা, তারপর জবাব দিল, ‘লাভ না হওয়ার মানেই ক্ষতি। আমারু একটা প্রিয় দর্শন, সিনর। আপনি কাপড় ছাড়বেন, সুটকেস খুলবেন,
সেই ফাকে আমরা কথা বলব, সিনর?’

“কি কথা? এখানে, এই লবিতে বললেই তো পারেন, অদূরে সাজানো বেতের চেয়ার আর টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল রানা ।

“ওহ নো! আমি ডন হোসে স্যামুয়েল দ্য হোমায়রা, সিনর–একজন অভিজাত ভদ্রলোক । প্রকাশ্য জায়গায় আমি তো কারও সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে
কথা বলতে পারি না। হয় আপনার কামরা, নাহয় আমার সুইটে, প্লীজ, সিনর।

দুঃখিত, ডেস্ক ক্লার্কের দিকে ফিরে হাত পাতল রানা । “আমার সময় হবেনা।’

চাবি দেবে কি, ডেস্ক ক্লার্কের চেহারায় অবিশ্বাস ফুটে উঠল, রানার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল সে । পিছন থেকে কথা বলে উঠল হোটেল ম্যানেজার, ওয়েটার দু জনকে নিয়ে একটু তফাতে এতক্ষণ মুর্তি হয়ে ছিল সে। সিনর, এক্সকিউজ মি, আপনার নিদারুণ ভুল হচ্ছে। উনি ডন হোমায়রা- এই এলাকার গর্ব।’

নিদারুণ ভুল হচ্ছে? ডেস্ক ক্লার্কের হাত থেকে চাবিটা ছো দিয়ে নিজেই নিয়ে নিল রানা । ‘হলে আর কি করা যাবে, হোক । আমি এই মুহূর্তে নিদারুণ ক্লান্ত, কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই ।’ সিড়ির দিকে এগোল ও, পিঠটা শক্ত হয়ে আছে।

ঠিক তখুনি চিৎকারটা হলো। ‘বেজম্মা কুত্তারা! হারামীর বাচ্চারা! ভাগ গেলি!

থামল রানা, ঘুরল, হন হন করে এগোল হোটেলের দরজা লক্ষ্য করে ।যা ধারণা করেছিল তাই, হোৎকা চেহারার তিনজন যুবক, গায়ে শার্ট নেই, সাদা শেভ্রোলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমেরিকান বুড়োটা অস্থিরভাবে ছুটোছুটি করছে শুধু, সাহস করে যুবকদের কাছে ঘেষতে পারছে না। অবশ্য রানাকে দোরগোড়ায় দেখে তার সাহস বেড়ে গেল । এক যুবকের পিছনে চলে এল সে, কাধ ধরে টান দিল । গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছিল যুবক, মাথা বের করে সিধে হলো সে, দুম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল বুড়োর চোয়ালে । “মাগো, মেরে ফেল্লো’ বলে আর্তনাদ করে উঠল বুড়ো, চিৎ হয়ে পড়ল রাস্তার ওপর।

ধীরেসুস্থে সিড়ি বেয়ে নামল রানা । “এই যে, শোনো তোমরা!” মৃদু কণ্ঠে ডাকল ও ।

স্থির হয়ে গেল ছোকরার দলটা । ধীরে ধীরে ঘুরল তারা, দেখল রানাকে । প্রথমে একজন, তারপর বাকি দু’জন কেঁপে কেঁপে হাসতে শুরু করল!

‘জানি তোমরা পালাবে, বলল রানা, আগের মতই মৃদুকণ্ঠ। “কিন্তু তার আগে লোকটার কাছে মাফ চেয়ে নাও ।” যেন গুরুজন হিসেবে কোমল সুরে উপদেশ দিচ্ছে ও । “তা না হলে মারব আমি!’

ছোকরার দল হাসতে ভূলে গেল। কাদতে ভূলে গেল ব্যথায় কাতর বুড়োটাও। ওদের সবার কাছে আগন্তকের আচরণ হাস্যকর আর অবাস্তব লাগছে।

মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ড, তারপর তিনজন আবার এক সাথে হেসে উঠল ওরা । শান্ত ভাব, নরম সুর দুর্বলের মিনতি বলে ধরে নিয়েছে তারা । একজন তো রানার দিকে খেয়াল রাখারও প্রয়োজন বোধ করল না, আবার জানালা
দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল গাড়ির ভেতর । বাকি দু’জন এগিয়ে এল । বোকা হাবা অজ্ঞাত পরিচয় কালেভদ্রে কপালে জোটে, হাতের সুখ মেটাবার এই সুযোগ ছাড়া যায় না। হোটেলের দোরগোড়ায় দাড়িয়ে রয়েছেন ডন হোমায়রা,
দেখতে পাচ্ছে তারা, ঠোটে প্রশ্রয়ের হাসি।

বুড়োর দিকে হাত তুলল রানা, বলল, “আমার দিকে নয়, ওদিকে যাও-মাফ চাও ।’

তুই মাফ চা, প্রথম যুবক বলল, সে-ই সামনে । প্রথমে দু’পা ধরে, তারপর মাঝখানের ঠ্যাংটা ধরে।’ রানার সামনে দাড়াল সে, ডান হাতের পেশী ফুলিয়ে দেখাচ্ছে । হঠাৎ তর্জনী দিয়ে রানার তলপেটে খোচা মারার ভঙ্গি করল সে, ভেবেছিল আত্মরক্ষার জন্যে আতকে উঠে পিছিয়ে যাবে রানা ।

কিন্তু তার প্রতিপক্ষ নড়ল না, চেহারাতেও কোন ভাবান্তর ঘটল না। মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত বোধ করল যুবক, আর তখুনি তৎপর হলো রানা ।

তাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিল ও । খুব জোরের সাথে নয়, ভিড় ঠেলে এগোবার ভঙ্গিতে ৷ এগোলও এক পা, হাত লম্বা করে দ্বিতীয় যুবকের চুল ধরল মুঠোর ভেতর, টান দিল হ্যাচকা-ঠিক নিজের দিকে নয়, একপাশে । মাথা নিচু
করে দ্বিতীয় যুবক তীরবেগে ছুটে এসে গুতো দিল প্রথম যুবকের বুকে । দু’জন ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে, এক লাফে ওদের সামনে ফিরে এল রানা । শুরু হলো যন্ত্রণাদায়ক, প্রাণ-সংহারী, নিরেট ঘুসির তুমুল বর্ষণ ।

সব কিছু ভূলে গেল ওরা । নিজেকে বাচাবার জন্যে মানুষ এতটা ব্যস্ত হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যুবক দু’জনের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, চোখ-কান-নাক সহ মুখটাকে রক্ষার জন্যে প্রাণপণ
চেষ্টা করছে ওরা, কিন্তু পারছে না। কে মারছে ভুলে গেছে ওরা, কিভাবে বা কোথেকে আসছে আঘাতগুলো তা-ও এখন আর কোন গুরুত্ব বহন করে না, শুধু ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঠেকাবার। ব্যথায় বিষিয়ে উঠল পেট, কাধ থেকে নেমে যাওয়া হাতে কোন সাড় নেই, দু’জনেরই ফুলে উঠে বন্ধ হয়ে গেছে একটা করে চোখ, নাকের ফুটো যেন রক্ত নিষ্কাশনের নর্দমা । দু’একটা মার চিনতে পারল বোধহয়, ঘুসি নয়, ভাজ করা কনুই থেকে এল। মাথায় লোহার ‘আঙটা আটকানোর মত একটা অনুভূতি হলো, আগন্তক এক হাত দিয়ে একজনের চুল ধরে রেখেছে, একই সাথে ভাজ করা হাটু দেবে গেল পেটের ভেতর।

ফোঁপাতে শুরু করল; কিন্তু বেশিক্ষণ নয় । মাফ চাইবে সে অবকাশও পাচ্ছে না। তৃতীয় যুবক আওয়াজ শুনে মাথা বের করেছে গাড়ির ভেতর থেকে, সিধে হয়েছে । ঠিক সেখানেই দাড়িয়ে আছে সে, ভূলে গেছে পালানোর কথা । আগন্তকের হাত আর পা বিশ্রাম বা বিরতি কাকে বলে জানে না, দৃষ্টি দিয়ে ওগুলোর বিদ্যুৎ গতি অনুসরণ করাও সম্ভব নয়। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে চম্পট দিল সে।

অবশেষে দয়া হলো রানার। মনে হলো একটু বোধহয় বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। কিন্তু রাগটা তখনও আছে। দু’জনকে বুড়োর দিকে পাঠাল। ‘মাফ চাও।’

ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাফ চাইল রক্তাক্ত ছোকরা দু’জন । বিদায় হচ্ছে তারা, বুড়ো উঠে দাড়াল, ছুটে গেল ওদের দিকে, চিৎকার করছে, ‘লাদরন! লাদরন!’

মানে? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল রানা।

চোর!

দাঁড়িয়ে রয়েছে ডন হোমায়রা ।

ব্রাভো, সিনর রড, বলল সে, নিঃশব্দে হাততালি দিল ।

কোন মন্তব্য না করে ধাপ ক’টা বেয়ে উঠতে শুরু করল রানা । ভেবেছিল পথ করে নিতে হবে, কিন্তু না, নিজেই দোরগোড়া থেকে সরে গেল ডন হোমায়রা ।

রানার পিছু নিয়ে সিড়ির গোড়ায় পৌছুল বুড়ো আমেরিকান, হাতে পাঁচ ডলারের নোটটা । “সিনর, এটা রাখুন, প্লীজ।’

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা।

‘জানি ফেরত চাইবেন, মারের যা নমুনা দেখলাম” তার আগেই দিয়ে দিচ্ছি, সিনর, করুণ মুখে বলল বুড়ো । “যে দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেটা আমি পালন করতে পারিনি ।’

“ঠিক যা চেয়েছিলাম তাই করেছ তুমি । চিৎকার ।’ হাসল রানা । “গাড়িতে ন্যাকড়া আছে, মুছে পরিষ্কার করে দিবে?
অবশ্যই, একশোবার, এক গাল হেসে গাড়ির দিকে হাঁটা দিল বুড়ো, নোটটা তাড়াহুড়ো করে চালান করে দিল পকেটে ।

রানার পিছু পিছু লবিতে ঢুকল ডন হোমায়রা। “দৃশ্যটা দেখে আমি আপনার ভক্ত হয়ে গেছি, সিনর। আমরা বন্ধু হতে পারি, তাই না? চলুন না, প্লীজ আমার সাথে বসে দু’ঢোক খাবেন?

“আপনি দেখছি ভারি নাছোড়বান্দা, দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছ থেকে সুটকেসটা হাতে নিয়ে বলল রানা । কৌতৃহল বোধ করছে ও। কি বলতে চায় লোকটা? “বেশ, চলুন। তবে দু’মিনিটের মধ্যে সারতে হবে আপনাকে । আমার কামরায় ।’

“ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ,” বলে পথ দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল ডন হোমায়রা । “দু’মিনিটই যথেষ্ট, সিনর।’

কাঠের দোতলা। করিডরের শেষ মাথায় দরজাটা খুলে নিজের কামরায় ঢুকল রানা, পিছু পিছু ডন হোমায়রা । কামরাটা তন্দুরের মত গরম, যদিও সিলিঙয়ে একটা ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পীডে।

মেক্সিকোর এদিকটায় ভদ্রলোকেরা খুব কমই আসে, সিনর, দুটো চেয়ারের একটায় বসল ডন হোমায়রা | “এয়ারকন্ডিশনিঙের তেমন কদর নেই । তবে আমার সুইটে এয়ারকুলার আছে ।”

বসল না রানা, একটা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর সামনে গিয়ে দাড়াল। নিচু টেবিল থেকে গ্লাস আর বরফের পাত্রটা নিজের দিকে টেনে নিল ডন হোমায়রা । দুটো গ্লাসে বরফ আর পানি ঢালল সে।

“প্লীজ, সিনর রড! টেবিলের দিকে চলে আসার ইঙ্গিত করল রানাকে ।

“আপনি যদি বসতে চান তো বসুন, মি. হোমায়রা, বলল রানা । “আমি শাওয়ারটা সেরে নিই ।’

সানন্দে মাথা ঝাকাল ডন হোমায়রা । “অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই ।’

জ্যাকেটটা খুলল রানা, আগ্রহের সাথে হোলস্টার আর পিস্তলটা দেখল ডন হোমায়রা। ভাবল, বোঝা গেল কর্তৃত্বের উৎসটা কি। সবই তার প্ল্যানের অনুকূলে ।

নাগালের কাছাকাছি পিস্তলটা রাখল রানা । ডন হোমায়রা লোকটাকে প্রথম দর্শনেই পছন্দ হয়নি বটে, কিন্তু লোকটা যে ধনী তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর ধনীরা গরীবদের চেয়ে অনেক বেশি ঠাণ্ডাও বিবেচক হয়, অন্তত নিজের ভাল বোঝার ক্ষেত্রে। হুট করে কিছু একটা করে বসবে, তেমন লোখ না হবারই কথা।

বাথরুমে ঢুকে দিগন্বর হলো রানা, শাওয়ারের নিচে দাড়াল, দরজাটা বন্ধ করেনি । আয়নার দিকে মুখ করে দাড়িয়েছে ও, ডন হোমায়রার মাথা আর গলা পিস্তলের দিকে নয়। দু’জন যদি একই সময়ে লাফ দেয়, রানাই আগে ওটার নাগাল পাবে।

“আপনাকে একটা পরামর্শ দিই, সিনর,’ চেয়ার থেকে বলল ডন হোমায়রা । “এদিকে যতদিন থাকবেন, পানির বদলে বিয়ার বা হুইস্কি খাবেন। তা না হলে জীবাণু আপনার বারোটা বাজিয়ে দেবে । বোতলের পানি খেতে পারেন, কিন্তু সব সময় পাবেন না।’

শাওয়ার সেরে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল রানা, একটা তোয়ালে কোমরে, আরেকটা দিয়ে মাথার চুল মুছছে। ডন হোমায়রার দিকে পিছন ফিরে ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর সামনে দাড়াল ও । মান্ধাতা আমলের একটা ট্রেন হুইসেলের ভোতা আওয়াজ তুলে কাছ থেকে দূরে চলে গেল, পাহাড় থেকে ফিরে আসতে লাগল প্রতিধ্বনিগুলো। স্টেশনের দিকে কালো ধোয়া দেখা গেল, অলসভঙ্গিতে আকাশ পাড়ি দিচ্ছে ।

পানির গ্রাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ডন হোমায়রা বলল, “আপনার জন্যে একটা কাজের প্রস্তাব আছে, সিনর রড ।’

“কি ধরনের কাজ?’ কৌতুক বোধ করল রানা । লোকটা তাহলে ওর পরিচয় জানে না।

হারমোজার কাছে আমার পুরানো খনিটা আবার খুলেছি, বলল ডন হোমাইরা। উত্তরের পাহাড়ি শহর হারমোজা, সিয়েরা মাদ্রের নিচে, আমেরিকান সীমান্তের কাছাকাছি। হারমোজা আর আর আশেপাশের এলাকা ভারি দুর্গম । চাষাগুলোকে পশুই বলতে পারেন আপনি, আর খনিতে যারা কাজ করে, ইন্ডিয়ানরা…’ বিরক্তিসূচক ভঙ্গিতে কাধ ঝাঁকাল ডন হোমায়রা ৷ ‘পরের মুখে শুনে কাজ কি, নিজের চোখেই তো সব দেখতে পাবেন । আমার আসলে রাশভারি একজন লোক দরকার, সিনর ৷ দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে মনে, ভয় লাগে, নত হয়ে আসে মাথা, এমন একজন লোক । কাজ? তেমন কিছুই নয়, শুধু দেখতে হবে শৃঙ্খলা বজায় থাকছে কিনা। কি বলছি বুঝতে পারছেন তো, সিনর?’

অদ্ভুত লোক তো, ভাবল রানা । “তা এই মুহূর্তে কে আপনার শৃঙ্খলা বজায় রাখছে, মি. হোমায়রা?’

“আহ্‌, সেকথা আর বলবেন না! ভাল এক লোক ছিল, সে-ও আমেরিকান, অত্যন্ত শক্তিশালী, অত্যন্ত লম্বা। আমেরিকায় ফেরার কোন ইচ্ছেও তার ছিল না, পুলিসের সাথে ঝামেলা বাধিয়ে পালিয়ে এসেছিল কিনা ।

কিন্তু মন্দ ভাগ্য আমার, দুঃখজনক একটা দুর্ঘটনায় তাকে আমি হারালাম। আবার মন্দ ভাগ্যই বা বলি কি ভাবে, তাকে হারিয়েছি ঠিক, কিন্তু আপনাকে তো পেলাম!

“এককথায়, বলল রানা, “আমাকে আপনি পাননি ।’

হাসল ডন হোমায়রা । “আপনার এই জিনিসটা, সিনর, আমার ভাল লাগল–এরই মধ্যে’ আপনি আমার বাচনভঙ্গি রপ্ত করে নিয়েছেন। দাড়ান, এখনও আপনি আমার টার্মস সম্পর্কে শোনেননি । ছ’মাস পাবেন পাচ-ছয়ে ত্রিশ হাজার ডলার, নিখাদ সোনায় । বছরের বাকি সময়টা প্রতি মাসে দশ হাজার ডলার, সে-ও ওই: নিখাদ সোনায় । কি, লোভনীয় নয়, সিনর?’

কথাগুলো শোনার ধৈর্য হওয়ায় নিজের প্রশংসা করল রানা । খুব আগ্রহের সাথে পাল্টা একটা প্রস্তাব দিল ও, “মেক্সিকোর এদিকটায় আগে কখনও আমি আসিনি, মি. হোমায়রা । যে ক’টা দিন থাকব আমার একটা চাকরি করবেন, প্লীজ? কাজ? তেমন কিছুই নয়, চারদিকটা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবেন আমাকে, ছোটখাট দু’একটা ফাই-ফরমাশ খাটবেন। বেতন? অমায়িক হাসল রানা। আপনি যা চান, যুক্তিসঙ্গত যে-কোন একটা অঙ্ক। কি, লোভনীয় নয়, সিনর?

ডন হোমায়রার কালো চোখে লালচে আগুন জ্বলে উঠল। এবড়োখেবড়ো কাটা দাগটা, এতক্ষণ লক্ষ করেনি রানা, হঠাৎ যেন ডান চোখের নিচে থেকে চিবুক পর্যন্ত চামড়া ফুঁড়ে জেগে উঠল । বুক পকেট থেকে লম্বা একটা চুরুট বের
করল ডন হোমায়রা, ধরাল সেটা । তার হাত কাপছে । আবার যখন মুখ তুলে তাকাল সে, সম্পূর্ণ শান্ত দেখাল তাকে আমি জানি, আপনি আমাকে অপনান করতে চাননি, সিনর। আমি আরও বুঝতে পারছি, মেক্সিকোর ধরন-ধারণ,
বিশেষ করে মেক্সিকোর এই এলাকার ধরন-ধারণ সম্পর্কে জানা নেই আপনার। আলতোভাবে চুরুটে টান দিল সে যেন আদর করে সস্নেহে চুমো, খাচ্ছে। “যদি কিছু চাই, সিনর রড, সাধারণত সেটা পাই আমি । আমাদের এখানে একটা প্রবচন চালু রয়েছে-অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে অবশ্যই তৈরি থাকতে হবে তোমাকে । বেশ, আপনার বেতন আমি দ্বিগুণ করে দিলাম। তাহলে সে-কথাই রইল, কেমন? আমার সাথে হারমোজায় যাচ্ছেন
আপনি । এটাই আমার ফাইনাল অফার ।’

‘থাঙ্কস, বাট, নো থাঙ্কস,’ নরম সুরে বলল রানা। আপনি ,বোধহয় ভুলে গেছেন আমি বলেছিলাম দু’মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না।’
ছড়ি হাতে চেয়ার ছাড়ল ডন হোমায়রা। “এটাই কি আপনার শেষ কথা, সিনর?

‘হ্যা, প্রথম কথাও তাই ছিল।” মৃদু হাসল রানা । “দুঃখিত, কেউই আমরা পরস্পরের চাকরি করতে পারলাম না।’

দরজা পর্যন্ত হেটে গেল ডন হোমায়রা ৷ “দুঃখিত আমিও, সিনর রড,
দুঃখিত আমিও।

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top