বন্দী গগল – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Bondi Gogol – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

ঝটিকা সফরে বেরিয়েছে মাসুদ রানা । বাৎসরিক রুটিন সফর, আগে. থেকেই ঠিক করা ছিল শিডিউল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করেছে ও, শেষ করছে ইউরোপে-ইতালির রোমে । রানা এজেন্সীর কোন শাখাতেই এক কি
বড়জোর দেড় দিনের বেশি থাকতে হইনি ওকে। তাতেই প্রায় মাস দেড়েক লেগে গেছে। পরিদর্শন, ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, নতুন নিয়ম শৃংখলা আরোপ, পেন্ডিং কেস নিয়ে মাথা ঘামানো, শাখা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক ইত্যাদি নীরস,
একঘেয়ে কাজে প্রতিদিন ষোলো ঘন্টা ব্যয় করেছে ও। সাংঘাতিক একটা ধকল গেছে শরীরটার ওপর দিয়ে । মনটাও হাপিয়ে উঠেছে। এখন রোম শাখার কাজটুকু শেষ করতে পারলেই পুরো আট ঘণ্টা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে ও।
তারপর মনটাকে আবার চাঙা করে তোলার জন্যে কিছু আনন্দ ফুর্তির আয়োজন করা যাবে। অভিজাত কিছু রোমান বন্ধু-বান্ধব আছে ওর, এ ব্যাপারে তারা ওকে সাহায্য করতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে। যদিও হাতে সময় নেই, ক’দিন পরই শেষ হয়ে যাবে বরাদ্দ ছুটি, আর ছুটি শেষ হলেই ফিরে যেতে হবে দেশে- তবু সাত দিনের আগে কাজের কথা ভাবতে পর্যন্ত রাজি নয় ও।

আজই বিকেলের ফ্লাইটে রোমে এসে পৌছেছে ও। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এসেছে রানা এজেন্সির অফিসে।

অভিজাত এলাকায় ছোট একটা দোতলা বাড়ি। নিচতলায় রানা এজেন্সীর শাখা । ওপর তলাটা নিজের ফ্ল্যাট হিসেবে ব্যবহার করছে শাখা প্রধান কন্টেসা (সাবেক) মারদাস্ত্রোয়ানি মোনিকা আলবিনো ।

নিচতলায় দুটো কামরা নিয়ে মোনিকার অফিস। প্রথম কামরাটায় চেম্বার। মোনিকার অধীনে কাজ করে আরও পচিশ-ত্রিশজন লোক, কিন্তু তাদের জন্যে অফিসে আলাদা কোন টেবিল নেই । তারা সরাসরি মোনিকার চেম্বারে আসে, কাজ বুঝে নিয়ে বা রিপোর্ট করে চলে যায়। এছাড়াও কামরাটার চাবি থাকে শুধু রানার কাছে। এজেন্সীর সকল শাখায় এই রকম একটা করে ব্যক্তিগত চেম্বার আছে ওর।

অফিসে পা দিতেই ছুটে এসে রানার হাত চেপে ধরেছে মোনিকা । টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছে নিজের চেয়ারে । তারপর নিজে চড়ে বসেছে ডেস্কের ওপর । হেডকোয়ার্টার, ব্যবসা, রানার স্বাস্থ্য, গিলটি মিয়া ইত্যাদি হাজারটা বিষয়ে অফুরন্ত কৌতুহল্‌ তার, প্রশ্ন করে সমস্ত জেনে নিতে চায় সে। নিজের হাতে তৈরি করে কফি খাইয়েছে রানাকে । আর মজার মজার অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছে। লক্ষ করেছে রানা, আগের মতই আছে দস্যি মেয়েটা, এতটুকু বদলায়নি । যতক্ষণ ঘরের ভেতর থাকে, ঘর যেন আলো করে রাখে। প্রথম দর্শনেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিকষ কালো এলোকেশ।
একটা বছর হবে । পাখনা মেলে দেয়া পাখির মত আয়ত দুটো চোখ । প্লেবয়রা ভোগের পাতা থেকে অপরূপ কোন ফ্যাশন মডেল উঠে এসেছে যেন। পরনে উলের তৈরি একটা আটো পোশাক, শরীরের উত্থান-পতনগুলো স্পষ্ট ।
বিউটি কনটেস্টের বিশেষজ্ঞ না হলেও, জানে রানা, এ-ধরনের ফিগার খুর কমই দেখা যায়।

রাত আটটার দিকে বাৎসরিক রিপোর্টের কথা উঠল, সবিনয় গর্বের সঙ্গে জানাল মোনিকা, এবছর কোন কেস পেন্ডিং নেই। কথাটা শুনে যুগপৎ খুশি ও বিস্মিত হলো রানা । শাখাগুলোর মধ্যে এটা এক আশ্চর্য রেকর্ড । সব শাখাতেই বেশ কিছু কেস পেন্ডিং পড়ে থাকে, সেগুলো অস্বাভাবিক জটিল বলেই । কিন্তু আশ্চর্য মেয়ে এই মোনিকা, কোন কেস তার হাতে পড়লে হয়, যত কঠিন আর জটিলই হোক, সমাধান সে ঠিকই বের করে ছাড়বে। রিপোর্টটা অবশ্য এই সব কেস সংক্রান্ত নয়, কেস ছাড়া আরও কিছু কাজ রয়েছে এজেন্সীর-সে সবের। স্টীলের আলমারি থেকে বের করে দিল’
মোনিকা টাইপ করা বাৎসরিক রিপোর্ট ।

একটু পরই রিপোর্টটা নিয়ে বসতে যাচ্ছে রানা, চেহেরায় একরাশ কুণ্ঠা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল মোনিকা। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ‘অধীনের একটা বিনীত প্রার্থনা ।”

বয়ান করো ।’

কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর মোনিকা জানাল ওর এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে পার্টি, সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলে ওর আর দেরি করা চলে না। ফিরতেও রাত হবে তার, ফেরার পথে অসুস্থ বাবাকে দেখার জন্য নার্সিং হোম হয়ে আসবে সে।
দশটা-পাঁচটা অফিস, তিন ঘন্টা আগেই অফিস সেক্রেটারি বিদায় নিয়ে চলে গেছে। পাঁচটার পর সাধারণত কোন মক্কেল আসে না, এলেও অফিস বন্ধ হয়ে গেছে বলে ফিরিয়ে দেয় দারোয়ান । রাতে কোন মক্কেল যদি ফোন করে, নিজের বেডরূম থেকে তার সঙ্গে কথা বলে মোনিকা। সাধারণ মক্কেলদের জানানো হয়, হাতে অনেক কেস জমে আছে নতুন কোন কেস নেয়া সম্ভব নয়।

মোনিকার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছে রানা । অফিসে একা হয়ে গেল ও। বান্ধবীর বিয়েতে ট্যাক্সি নিয়ে গেছে মোনিকা, রানার জন্যে রেখে গেছে নিজের মরিস ম্যারিনা।

কিন্তু মোনিকা চলে যাওয়ার পরপরই এক মক্কেল এসে হাজির। কোন সমস্যা নিয়ে নয়, তার একটা সমস্যার সমাধান করে দিয়ে রানা এজেন্সার এই শাখা কিছু টাকা রোজগার করেছে, সেই টাকাটা দিতে এসেছিলেন তিনি। আরও লোক আসতে পারে ভেবে ভেতর থেকে অফিসের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল ও। তারপর নিজের চেম্বারে বসে আবার মনোযোগ দিল মোনিকার রিপোর্টে । যেসব বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন তার নিচে দাগ দিচ্ছে লাল বলপেন দিয়ে ।

কিন্তু ঝামেলা যে ঘরের ভেতরই রয়ে গেছে তা একটু পরই টের পেল রানা । সাড়ে আটটার দিকে ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন । রিসিভার তুলল ও । পাঁচ সেকেন্ড পর “রং নাম্বার বলে নামিয়ে রাখল সেটা । দশ মিনিট যেতে না যেতে আবার টেলিফোন । বিরক্ত বোধ করলেও, রিসিভারের দিকে হাত বাড়াতে এক মুহূর্ত ইতস্তত করেনি ও। ইনি একজন মহিলা মক্কেল, তার মেয়েকে একদল ড্রাগ অ্যাডিক্টের কবল থেকে উদ্ধার করে দিয়েছে মোনিকা; সেজন্যে ধন্যবাদ জানাতে চান। ধন্যবাদ পৌছে দেয়া হবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেহাই পেল রানা ।

পৌনে দশটা । প্রায় দেড় ঘন্টা হলো আর কেউ বিরক্ত করেনি রানাকে । মোনিকার বাৎসরিক রিপোর্ট এই মাত্র পড়ে শেষ করেছে ও! ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেলান দিল চেয়ারে । আশ্চর্য হালকা লাগছে মাথাটা, যেন দু’মণ ওজনের একটা পাথর নেমে গেছে। মনের পর্দায় ভেসে উঠল নীল সাগর। মাথায় সাদা ফেনার মুকুট পরা উথালপাথাল ঢেউ, বোটের গায়ে ছল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। হু হু বাতাস, মাথার ওপর পাখনা মেলে দেয়া
শংখচিল |

কিন্তু এসবের মধ্যেও কাটার মত বিধছে ছোট্ট একটা সমস্যা ৷ রিপোর্টের শেষদিকে মোনিকা একটা তদন্তের কথা উল্লেখ করেছে । সেটার কথা চেষ্টা করেও ভুলতে পারছেনা ও।

একটা সিগারেট ধরাল রানা । একমুখ ধোয়া ছেড়ে আবার হেলান দিল চেয়ারে । সিলিংয়ের দিকে তাকাল। দুই ভূরুর মাঝখানে একটা ভাজ। মোনিকার বাৎসরিক রিপোর্ট দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা ওর, হয়েছেও, কিন্তু ড্রাগস স্মাগলিংয়ের ওপর যে ব্যক্তিগত রিপোর্টটা তৈরি করতে শুরু করেছিল সে, সেটা শেষ করেনি । কারণটা বুঝতে পারছে না রানা । সেজন্যেই খুত খুত করছে মন।

সিগারেটে কষে একটা টান দিয়ে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিল রানা । সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে মাথা-না ঘামালেও চলবে । কাল সকালেই জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে সব। চোখ বুজতেই আবার সেই ছুটির আমেজ ভরা সাগরের হাতছানি! ঠিক এই সময় ওকে চমকে দিয়ে বেরসিকের মত বেজে উঠল টেলিফোন । সংবিৎ ফিরে পেয়েই রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল ও ।

দশটা বেজে পাঁচ। আবার কে ফোন করল? রিসিভার তুলল ও। ইনিও একজন মক্কেল, সম্ভবত স্ত্রীর ঝগড়া শেষ করে টেলিফোন করেছেন, জানতে চাইলেন ডিভোর্স সংক্রান্ত কোন কেস নেয়া হয় কিনা । হয়, কিন্তু অফিস আওয়ারের পরে নয়, কথাটা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল ও । এবার অফিস থেকে বেরুতে হয়। কখন আবার কোন্‌ ঝামেলা ঘাড়ে এসে চাপে । চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে, ঝন ঝন শব্দে আবার বেজে উঠল টেলিফোন । ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলও। হতে পারে কল্পনা বা কুসংস্কার, কিন্তু টেলিফোনের এই শব্দটায় কেমন যেন বিপদের গন্ধ পেল ও । অন্তর থেকে উৎসাহ তো পেলই না, বরং কলটাকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করল । কিন্তু বাধা দিল বিবেক । হাত বাড়িয়ে সাবধানে কানের কাছে তুলল রিসিভার। হ্যালো?

একটা পুরুষ কন্ঠ জানতে চাইল, “রানা এজেন্সি?” ভরাট আর বক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর, কিন্তু কেমন যেন বেসুরো লাগ্লো রানার কানে। লোকটা একটু হাপাচ্ছে।
হ্যা, বলল রানা ।

আমার নাম জা দুবে। বিশেষ একটা জরুরী ব্যাপারে আমি আপনাদের সার্ভিস…”

‘দুঃখিত,’ লোকটাকে বাধা দিয়ে বলল রানা, “অফিস বন্ধ হয়ে গেছে ।

‘বন্ধ হয়ে গেছে! লোকটা প্রায় আতকে উঠল। “আপনাদের নাইট সার্ভিস নেই

“নেই, ভারী গলায় জানিয়ে দিল রানা । “কাজের চাপ, নতুন কোন্‌ কেসও নেয়া হয় না।’

রিসিভার রেখে দিতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু লোকটা দ্র্ত জানতে চাইল, “আপনি কে বলছেন, প্লীজ?’ নিঃশ্বাসের শব্দ পড়তে একটু দেরি হলো লক্ষ করে রানা অনুমান করল, লোকটা বোধহয় ঢোক গিলল।

, “সিনর রানা, আবেদনের সুরে বলল লোকটা, “হঠাৎ একটা বিপদ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছি আমি, আপনি যদি দয়া করে আমার এখানে একবার আসেন…প্লীজ! অত্যন্ত আর্জেন্ট একটা ব্যাপার ।’

ভ্রু কুচকে উঠল রানার । মনে হলো, লোকটা ভয় পেয়েছে। আবার তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পতনের শব্দ পেল ও।

সিনর রানা!

ভয় পেয়েছে লোকটা, তাতে কোন সন্দেহ নেই । একটু কৌতুহল বোধ করল ও । কিন্ত সেটাকে গলা টিপে মারল, বলল, আপনি বরং অন্য কোন এজেন্সীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন ।

‘কিন্তৃ…”না! তার আগেই যদি ওরা… লোকটা হাঁসফাঁস করছে। ‘তাছাড়া, এর আগে আরও দুটো প্রতিষ্ঠানে ফোন করে কোন সাড়া পাইনি, সিনর রানা। এতরাতে আর কোন ইনভেস্টিগেশন ফার্ম খোলা পাব বলে মনে হয় না। এখন আপনি যদি সাহায্য না করেন, আমি হয়তো….আমাকে হয়তো…”

চুপ করে গেল লোকটা ।

রানার মনে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কৌতুহল । এব।। সেটাকে গলা টিপে মারার্‌ চেষ্টা করেও পারল না। জানতে চাইল, ‘আপনার সমস্যাটা কি, সিনর দুবে?’

একটু দম নিল লোকটা, তারপর দ্র্ত বলতে শুরু করল, “একটু আগে আমি একটা টেলিফোন পেয়েছি । আজ রাতে আমাকে নাকি কিডন্যাপ করা…”

আবার বাধা দিল রানা, বলল, “পুলিসে খবর দিন ।’
তারা ভাববে, লোকটা হয়তো ঠাট্টা করছে, ভয় দেখিয়ে মজা পেতে চায়” জবাব দিল লোকটা । “পুলিস ডেকে লোক হাসাতে চাই না, তাই…”
একটু রাগ হলো রানার। বলল, পুলিস ডেকে লোক হাসাতে চান না বলে এত রাতে যাকে তাকে ফোন করে বিরক্ত করতে হবে নাকি? শুনুন, আমরা কাউকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নিই না। কাজেই, অন্য কোথাও চেষ্টা করুন।” রিসিভারটা রেখে দিতে গিয়েও আবার সেই কৌতুহল থেকে জানতে চাইল, ‘কোথেকে বলছেন আপনি? বাড়িতে লোকজন নেই?”

‘শুধু একজন ফিলিপিনো শোফার” গলাটা একেবারে খাদে নামিয়ে বলল লোকটা, যেন কেউ শুনতে না পায়। “তার ওপর ভরসা রাখতে পারছি না। প্লীজ, সিনর! হেলপ মি! হয়তো দেরি হয়ে যাচ্ছে…”

ব্যাপারটা গোলমেলে লাগল রানার কাছে । ঝট করে যে রিসিভার নামিয়ে রাখবে, পারল না । অনিচ্ছাসত্বেও জানতে চাইল, “কেউ আপনাকে কিডন্যাপ করতে চাইবে কেন?’

“আমি পাপিয়া ক্যালিয়ারির স্বামী, দ্রুত বলল লোকটা, ‘আপনি এখানে এসে পৌছুলে সব কথা…”

পাপিয়া ক্যালিয়ারি। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী চার মহিলার একজন। তার স্বামীকে কিডন্যাপ করতে চাওয়ার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই । ধনী লোকদের আত্বীয়-স্বজনকে কিডন্যাপ করার ঘটনা ইদানীং প্রায়ই ঘটছে।

‘সিনর রানা!” ব্যাকুল কণ্ঠস্বর ।

“কোথেকে বলছেন আপনি?” এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি রানা ।

‘বেন ভেনুতো…’

‘চিনি…’

‘গেটটা খোলাই পাবেন, লোকটা ধরেই নিয়েছে, রানা যাচ্ছে । ‘আসলে এখানে আর্মি এইমাত্র এসে পৌছেছি, এবং…” হঠাৎ চুপ করে গেল জা দুবে।

অপেক্ষা করল রানা । কিন্তু তবু কোন সাড়া না পেয়ে বলল, হ্যালো?

আরও তিন সেকেন্ড পর জা দুবের ভারী নিঃশ্বাস পতনের আওয়াজ পেল রানা । ঘন ঘন হাপাচ্ছে লোকটা । কিন্তু উত্তর দিল না। একটা গাড়ির হর্নের আওয়াজ পাওয়া গেল রিসিভারে ।

”হ্যালো? সিনর দুবে?’

এবার হঠাৎ করেই নিঃশ্বাসের আওয়াজটা থেমে গেল। তারপর দীর্ঘ, শব্দহীন একটা বিরতি । শেষে মৃদু একটা ক্লিক শব্দের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগ ।

দুই


বেন ভেনুতো, অর্থাৎ স্বাগতম । অফিস থেকে মাইল তিনেক দূরে বাড়িটা । ত্রিশের দশকে একজন ধনকুবেরের জন্যে তৈরি করা হলেও সে কখনও বাড়িটায় বসবাস করেনি । গৃহে পদার্পণের আগেই তার আর্থিক বুনিয়াদ ধসে পড়ে, ফলে নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে ভবলীলা সাঙ্গ করে সে । এরপর অনেক বছর খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। শেষে একটা সিন্ডিকেট নিলাম ডেকে কিনে নেয়, সেই থেকে দেশী-বিদেশী মিলিয়নিয়ারদের সাময়িক ভাড়া দিয়ে প্রচুর লাভের মুখ দেখছে, তারা । ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতেও যারা থাকতে চান না সেই অতি সৌখিন ধনী ব্যক্তিরাই এখানে ছুটি কাটাতে বা বিশ্রাম নিতে আসেন। বাড়িটাকে আধুনিক রাজপ্রাসাদ বলা যেতে পারে, বিজ্ঞাপনে এটাকে
ধনকুবেরদের স্বপ্নপুরী বলে প্রচার করা হয়। বাড়িটার সঙ্গে উচু পাচিল দিয়ে ঘেরা একশো একর জায়গা জোড়া মস্ত বাগান, আর সবচেয়ে বড় সুইমিং পুলটা পড়েছে অর্ধেক বাড়ির ভিতর, বাকি অর্ধেক বাড়ির বাইরে। বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে ইটালিয়ান বারোক ধাচে, সমস্তটাই কংক্রিট আর মস্ণ পাথরের সাহায্যে । বাড়ির ভেতরটা বিখ্যাত হয়ে আছে অপূর্ব কিছু মুরাল আর শিল্পকর্মের জন্যে ।

রেস্তোরা ভেরোনার সামনে থেকে শুরু হয়ে দু’মাইল এগিয়ে গেছে প্রাইভেট রাস্তাটা। চওড়া, সমতল, দু’পাশে রয়্যাল পাম গাছ দাঁড়ানো সুন্দর রাস্তা, সোজা চলে গেছে বেন ভেনুতো পর্যন্ত । ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে মরিস ম্যারিনা। ঠোঁটে সিগারেট, মাথাটা একপাশে একটু কাত করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে রানা । হঠাৎ একটা কথার মাঝখানে চুপ করে যাওয়ার কি মানে হতে পারে? জা দুবের কথা ভাবছে ও । কোন গাড়িকে আসতে দেখেছিল? হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকেছিল? টেলিফোনে যা বলছিল তাকে সেটা শুনতে দিতে চায়নি?

সামনে এস্টেটের খোলা মেইন গেট দেখতে পেল রানা । গাড়ির স্পীড কমাল না। গেটের ভেতর চওড়া রাস্তা, দু’পাশে রডোডেনড্রনের ঝোপ। গাড়িটাকে মস্ত, এক বাক ঘুরিয়ে আবার সোজা করল ও। হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাধিয়ে যেন ঝলমল করে উঠল বাড়িটা । খ্যাচ করে বেক কষল রানা । কংক্রিটের সঙ্গে টায়ারের ঘর্ষণে তীক্ষ আওয়াজ উঠল। তীব্র একটা ঝাকি খেয়ে দাড়িয়ে পড়ল গাড়ি সাদা রেলিঙের পাশে । দরজা খুলে নিচে নামল ও। চোখ ‘বুলিয়ে দেখে নিল চারদিক । মস্ত উঠানটা ইস্পাতের নিচু রেলিং দিয়ে ঘেরা । সামনেই একটা গেট, ভেতরে ঢুকে সোজা গাড়ি-বারান্দার দিকে এগোল রানা । সেখানে কালো একটা আলফা রোমিও দাড়িয়ে আছে, পার্কিং লাইট অন করা । কোথাও কিছু নড়ছে না। ডান হাতটা পকেটে ভরে আলফা রোমিওর পাশ ঘেষে এগোল ও | সামনে কয়েকটা ধাপ। টেরেসের শেষ মাথায় বিশাল একটা খিলান, সেটার ভেতর থেকে উজ্জ্বল একটা আলো বেরিয়ে আসছে, তাছাড়া গোটা বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা । ব্যাপার কি?

টেরেসের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে এগোল রানা । খিলানের পাশে একটা জানালা, ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেঃ একটা চৌকো হলরুম মেক্সিকান স্টাইলে সাজানো । প্রত্যেকটা দরজার সামনে রেলিং ঘেরা বারান্দা, সিলিং থেকে ঝুলছে রঙচঙে ঝাড়বাতি, দেয়ালে পেইন্টিং মেঝেতে মেক্সিকান কার্পেট । কামরার ভেতর কাউকে দেখা গেল না। জানালার কাছ থেকে সরে এল। টেলিফোনটা দেখল ও। টেলিফোনের পাশেই একটা টাম্বলার, তাতে হুইস্কি, এবং সম্ভবত সোডা । ছোয়নি কেউ । কাচের অ্যাশট্রে থেকে গড়িয়ে পড়ে গেছে একটা ফিল্টার টিপ সিগারেট, মেহগনি কাঠ পুড়ে কালচে হয়ে গেছে খানিকটা ।

কেউ নেই কামরার ভেতর।

সিগারেটের অবশিস্টাংশ আর হুইস্কিটুকু চিন্তিত করে তুলল রানাকে। সিগারেটের লম্বা ছাই দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, মাত্র দু’একটা টান দিয়েই ফেলে দিয়েছে কেউ। আর হুইস্কিটুকু ঢালা হয়েছে টাম্বলারে, কিন্তু স্পর্শ করা হইনি। দুটোই অসমাপ্ত কাজ । লক্ষণ ভাল নয়। রূমে তিন্‌ সেট সোফা। একটা, বৃত্তের মত করে সাজানো । বাক নিয়ে ঘুরতে গিয়েই ছ্যাৎ করে উঠল ওর বুক। থমকে দাড়িয়ে পড়ল । মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কে কার্পেটের ওপর । মারা গেছে কিনা বোঝার জন্যে তোকে আর ছুয়ে দেখার প্রেয়োজন হলো না। কার্পেটের ওপর কাত্‌ হয়ে রয়েছে মুখ, কপালের মাঝখানে গভীর একটা ফুটো, দেখল রানা । সব রক্ত শুষে নিয়েছে মেক্সিকান কার্পেট, শুধু কালচে একটা দাগ লেগে রয়েছে সেখানে । তামাটে হলুদ রঙের হাত দুটো শক্ত হয়ে রয়েছে, ছড়ানো আঙুলগুলো বড়শির মত বাকা । মুখটা ছোট, তামাটে রঙের আতঙ্কের মুখোশ এঁটে দিয়েছে যেন কেউ। ঝুঁকে পড়ে শক্ত একটা হাত ছুলো রানা । এখনও গরম। তার মানে কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে সে। ইউনিফর্ম দেখে রোঝা যায়, এই ফিলিপিনো শোফারের কথাই বলেছিল জা দুবে।

জা দুবের কপালে কি ঘটেছে, অনুমান করতে অসুবিধে হলো না রানার । সে যখন কথা বলছিল টেলিফোনে ঠিক তখনই বোধহয় কিডন্যাপাররা হলঘরে ঢোকে । লাশের সামনে দাড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল রানা। এটা শুধু
একটা শোফার হত্যারহস্য নয়, এটা একটা কিডন্যাপিংয়ের কেসও বটে। এবং সাধারণ একজন লোক নয়, কিডন্যাপ করা হয়েছে পাপিয়া ক্যালিয়ারির স্বামীকে । শুধু রোম নয়, গোটা ইটালিতে হৈচৈ পড়ে যাবে । স্থানীয় পুলিস ক্যাপ্টেন সম্পর্কে খুব ভালো জানা আছে রানার, মোনিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নয়। রানা এজেন্সির নাম শুনলেই নাকি লোকটার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে করার কিছু নেইও ওর, পুলিসে খবর দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই সব দিক থেকে ভাল । পুলিস ক্যাপ্টেন রোমা যদি জানতে পারে তাঁকে খবর দিয়ে খামোকা সময় নস্ট করা হয়েছে, ‘জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়বে সে।

এগিয়ে এসে টেলিফোনের সামনে দাড়াল রানা । রিসিভারটা ধরতে যাবে, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল হাতটা । মাথাটা এক দিকে একটু কাত্‌ করে কি যেন শোনার চেষ্টা করল ও।

শব্দ শুনে মনে হলো একটা গাড়ি। হ্যা, তাই। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে। অত্যন্ত শক্তিশালী ইজিন, আক্রোশে যেন গর্জন করছে। প্রাইভেট রাস্তায় বাক নেয়ার সময় চারটে টায়ারের তীব্র ঘর্ষণের আওয়াজ পেল রানা । রিসিভারের দিক থেকে হাতটা সরিয়ে নিল ও । দ্রুত এগিয়ে গিয়ে খিলানের নিচে দাঁড়াল। গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে গাড়িটার হেডলাইট দেখা গেল। বাক ঘুরে স্যাত করে কাছে চলে এল গাড়িটা, তীব্র একটা ঝাকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মরিস ম্যারিনার পাশে । খিলানের নিচ থেকে টেরেসে বেরিয়ে এল ও। ধীর পায়ে এগোল। টেরেস থেকে বাগানে নেমে গেছে সিড়ির ক’টা ধাপ। সিড়ির মাথায় গিয়ে দাড়াল ও | গাড়ি থেকে নামল একটা মেয়ে । পরিষ্কার দেখতে-পেল না রানা । “শুধু বুঝল, মেয়েটার মাথায় হ্যাট নেই, বেশ লম্বা, একহারা ।

‘জা…’ হঠাৎ রানাকে দেখতে পেয়ে থমকে গেল মেয়েটা, “ওখানে কে…জা তুমি?’

‘সিনর দুবে এখানে আছেন বলে তো মনে হয় না,’ বলল রানা । সিড়ির ধাপ ক’টা টপকে নেমে এল টেরেস থেকে । কাছাকাছি পৌছুবার আগেই মেয়েটার নিঃশ্বাস চেপে ফেলার আওয়াজ পেল ও । শরীরটা প্রায় আধপাক ঘুরিয়ে নিল, যেন ছুটে পালাতে চায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে, বোধহয় বুঝতে পেরেছে এখন আর লোকটার কাছ থেকে ছুটে পালানো সন্তব নয়।

“কে… কে আপনি?”

‘আমার নাম মাসুদ রানা।’

‘এখানে কি করছেন আপনি?’
‘মিনিট পনেরো আগে সিনর দুবে আমাকে ফোন করে আসতে বলেন।’ ‘ও! আতকে ওঠার মত আওয়াজ। “অথচ আপনি বলছেন এখানে নেই তিনি?’

“সেই রকমই তো মনে হচ্ছে । হলঘরের ভেতর ওই একটা মাত্র আলো । তাছাড়া গোটা বাড়ি অন্ধকার ।’ ইতোমধ্যে মেয়েটার কাছাকাছি পৌছে গেছে রানা । দেখল পরনে সান্ধ্য পোশাক, আহামরি না হলেও সুন্দরী বলা চলে?

যাবেন কোথায়! নিশ্য়ই তিনি এখানেই কোথাও আছেন, তীক্ষ প্রতিবাদের সুরে বলল সে।

“আপনি কে জানতে পারি?”

মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল মেয়েটা । তারপর বলল, “মেরী ভার্না, সিনোরা দুবের সেক্রেটারি।’

“একটা দুঃসংবাদ” মৃদু গলায় বলল রানা । “পুলিসের মুখ থেকে শুনলেই ভাল হত…’

আবার আতকে উঠল মেরী ভার্না। “দুঃসংবাদ?
‘সিনর দুবের শোফার রয়েছে হলঘরে,’ মেরী ভার্নার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্যে তীক্ষ হলো রানার দৃষ্টি । “মারা গেছে সে।’

“মারা গেছে?” শিউরে উঠল মেরী ।

“গুলি করা হয়েছে কপালে ।’

টলে উঠল মেরী, বাতাস লাগা গাছের মত হেলে পড়ল সামনের দিকে! তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে সোজা করে রাখল রানা । “আপনি বরং কিছুক্ষণ গাড়ির ভেতরই বসে অপেক্ষা করুন। আমি পুলিসে…’

মৃদু একটা ঝাকি দিয়ে নিজেকে রানার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল মেরী । “ধন্যবাদ, আমি ঠিক আছি । আপনি বলছেন, খুন করা হয়েছে ওকে?’

‘সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। না, আত্মহত্যা নয়।’

‘জা–জা”…সিনর দুবে, তার কি হয়েছে?

“কি করে বলব বলুন। টেলিফোন করে আমাকে বললেন, কে যেন তাকে কিডন্যাপ করবে বলে হুমকি দিয়েছে।’ একটু দ্বিধা করে সত্যি কথাটাই বলল রানা।

‘কিডন্যাপ? জিসাস!’ আতঙ্কে বিকৃত শোনাল মেরীর গলা । কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চাইল, “আপনি ঠিক শুনেছেন? কিডন্যাপিংয়ের কথা বলেছেন তিনি?

‘হ্যা। তবে বাড়িটা এখনও সার্চ করে দেখা হয়নি। এই মাত্র এসে পৌচেছি আমি। এখন আপনি যদি আপনার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করেন” না” অধৈর্ষের সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মেরী, “আপনার সঙ্গে’ আমিও খুজব ওকে। কিন্তু…ওকে কেউ কিডন্যাপ করতে চাইবে কেন?

কথাটা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, আমি পাপিয়া ক্যালিয়ারির স্বামী” ।’

রানাকে ঠেলে সামনে এগোল মেরী । সিঁড়ির ধাপ ক’টা টপকে দ্রুত উঠে গেল টেরেসে। অনুসরণ করে ছুটল রানা । মেরীর সামনে চলে এসে পথরোধ করে দাড়াল । বলল, “হলঘরে আপনার যাওয়া উচিত হবে না।” কয়েক মুহুর্ত রানার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকল মেরী। তারপর ঝর করে কেদে ফেলল। “কেন? আবেগরুদ্ধ গলায় জানতে চাইল সে।
‘হলঘরে ওর লাশ’…দোহাই আপনার, সত্যি কথা বলুন! আপনি ওর লাশ দেখেছেন, তাই না?

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top