বুশ পাইলট – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Bush Pilot – Masud Rana By kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

সামনে ডাঙ্গা দেখা যেতে সাগরের তিন হাজার ফুট উপরে প্লেন নামিয়ো আনল রানা । চাঁদের উজ্জ্বল সাদা আলোয় গ্রীনল্যান্ড আইস-ক্যাপ মুক্তোর মালার মত জ্বলছে।

কেপ ডেজোলেশনের পুবদিকে জুলিয়ান বাইট ধোয়াটে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে ঘোষণা করছে বাতাসের জোর একেবারেই নেই, বড়জোর পাঁচ নর্ট। ভালই হলো ওর জন্য। আর কিছু না হোক, অস্তত একটা সুবিধে হবে, ফিয়র্ডের মাথার কাছে উপত্যকায় নামার সুযোগ পাবে ।

ভাঙা উইন্ডক্রীন দিয়ে হিমশীতল বাতাস চুইয়ে ঢুকে কেবিনটাকেও ঠান্ডা করে ফেলেছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের অসংখ্য আলো দৃষ্টিকে কেমন বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আলোগুলো সব মিলেমিশে একাকার, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

দূরে, কুয়াশার ওপাশে জোস্নায় ঝলমল করে উঠল রূপালী-সাদা ফিয়র্ড ৷ তার ওপাশে আইস-ক্যাপের প্রতিটি আদল তীক্ষ করে তুলেছে চাদের আলো।

সময় হয়েছে। গতি কমাল রানা । প্লেনের নিয়ন্ত্রণ অটোপাইলটে ছেড়ে দিয়ে সেফটি বেল্ট খুলল। পরিচিত দৃশ্যটা লাফ দিয়ে উঠে এল আবার চোখের সামনে । অসীম শূন্যের দিকে স্থির নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেহটা কো-পাইলটের সিটে অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের আলোর কারসাজিতে মাঝে মাঝে উদাও হয়ে যাচ্ছে মুন্ডুটা।

কেবিনের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল রানা। হোঁচট খেতে খেতে এসে এক হাটুতে ভর দিয়ে বসল অন্য দেহটার পাশে। হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দেখল বরফ-কঠিন ঠান্ডা মুখটা। নাহ, মরে গেছে কোন সন্দেহ নেই। উঠে দাঁড়িয়ে এগোল আবার অন্ধকারের দিকে। হাতড়ে খুঁজে বের করল এগজিট্‌ হ্যাচের কুইক রিলিজ হ্যান্ডেলটা।

রাতের আকাশে উড়ে চলেছে প্লেন। নির্ধিধায় শূন্যে ঝাঁপ দিল ও । তীব্র ঠাণ্ডা যেন গিলে নিল ওকে। ডিগবাজি খেয়ে পড়তে পড়তে মাথার উপুর দিয়ে পুবদিকে উড়ে যেতে দেখল প্লেনটাকে, চাদের আলোয় ভূতুড়ে লাগছে ওটাকে ।

প্যারাশুট খোলার রিঙের দিকে হাত বাড়াল ও। জায়গামত পেল না জিনিসটা । চমকে উঠল। নেই নাকি! সর্বনাশ!

ঘুম ভেঙে গেল। দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত চিত হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল রানা। তারপর একটানে গায়ের উপর থেকে চাদরটা সরালো।

মাথা ধরেছে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে টের পেল আড়ষ্ট লাগছে শরীরটা । জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ও। হাত দিয়ে ডলে কাচে লেগে থাকা বাম্পকণা সরাতেই সকালটা যেন উজ্জ্বল হেসে অভিনন্দন জানাল ওকে । মন জুড়ে থাকা দুঃস্বপ্নের রেশ মুহূর্তে কেটে গেল সে-হাসিতে ।

ফ্রেডেরিকসবর্গে রয়েছে এখন ও । রাজধানী ন্যুক ওখান থেকে বেশি দূরে না। “উত্তর-পশ্চিম উপকূলে, আর্কটিক সার্কেলের প্রায় দুশো গজ নীচে এই জায়গাটা । জনসংখ্যা খুবই কম–বড়জোর পনেরোশো, তা-ও বাইরে থেকে আসা তিন-চারশো মানুষকে নিয়ে। বাইরে থেকে যারা এসেছে তার মধ্যে তিনশো জন আছে নির্মাণ শ্রমিক, ডেনমার্ক সরকার সাময়িকভাবে নিয়োগ দিয়েছে ওদের, শুধু গ্রীষ্মকালে কাজ করার জন্য ।

গ্রীনল্যান্ড উপকূলের আর দশটা পুরানো শহরের মতই অনুন্নত শহর ফ্রিডেরিকসবর। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সমুদ্রে মাছ ধরা। কিছু কিছু ভেড়ার খামারও আছে। মেইন রোডটা এখনও আস্তরবিহীন ৷ ঘরবাড়িগুলো বেশির ভাগই কাঠ দিয়ে তৈরি; লাল, হলুদ, আর সবুজ রঙ করা; টেলিফোন লাইন ও বিদ্যুতের তার জড়াজড়ি করে রয়েছে অসংখ্য থামের গায়ে ।

বন্দরটা রয়েছে শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে আধ মাইল দুরে, পাথরে তৈরি মেইন রোডের শেষ মাথায়, নতুন গড়ে ওঠা একটা ক্যানিং ফ্যাক্টরির ধারে। তাতে নোঙর করা আধ ডজন ফিশিং বোট আর উপকূলে টহল দেয়ার জন্য ঈস্ট ক্যানাডা এয়ারওয়েজের একটা ক্যাটালিনা ফ্লাইং বোট। ক্যানিং ফ্যাক্টরি থেকে থেকে দুশো গজ দূরে কাটাতারে ঘেরা একটা ছয়তলা পাকা বাড়ি, তৈরি হয়েছে বছর কয়েক হলো, গেটে কড়া প্রহরা। ওখানে পাহারার বহর দেখলে মনে হয়, পারমাণবিক বোমা বানানোর কারখানা বুঝি। আসলে অত্যাধুনিক একটা গবেষণাগার ওটা। আর্কটিক অঞ্চলের সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করা হয়। ওটার ডিরেক্টর একজন আমেরিকান, আর আ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর বাংলাদেশী বিজ্ঞানী, ডক্টর সৈয়দ আবেদুর রহমান । মেরিন সায়েন্টিস্ট হিসেবে খুব নাম করেছেন।

এই অঞ্চলের সামুদ্রিক উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক অত্যাশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করেছেন তিনি। অনেকটা তার উত্তরসূরি প্রফেসর আদনান মনসুরের মতই যুগান্তকারী আবিষ্কার । দুজন দুই পথে এগিয়ে প্রায় একই জায়গায়
পৌছেছেন। জলরাক্ষস বা কিলার ওয়েইলের আক্রমণে নিহত হওয়ার আগে প্রফেসর মনসুর রানাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তার গবেষণার ফসল । কিন্ত্ব বাংলাদেশে এনে দেখা গেল ওটা এমনই -এক সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা যে তিনি ছাড়া আর কারেওপেক্ষে তার অর্ধদ্ধার করা সম্ভব নয়। অনেক চেষ্টার পর তার বিদুষী কন্যা মনিকাও হার মেনেছেন।

সৈয়দর আবেদুরর রহমানও মেরু অঞ্চলের শৈবাল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন, যার প্রয়োগে কেবল ধান, গম বা ভুট্টা নয়, যে-কোনও ধরনের ফল-মূল ও তরি-তরকারির ফলন হবে চার থেকে ছয়গুণ। পৃথিবীতে খাদ্যাভাব বলে কিছুই থাকবে না।

ড. আবেদ আমেরিকান গবেষণাগারে যে-কাজ করছেন, তার সঙ্গে এই আবিষ্কারের কোনও সম্পর্ক নেই । কিন্ত্র তার বস, ওই রিসার্চ সেন্টারের চিফ, কী করে যেন আন্দাজ করে ফেলেছেন এই আবিষ্কারের কথা । বাকি কাজ শেষ করে,
ফর্মুলাটা তার হাতে তুলে দেবার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ড. আবেদ জানেন, বসের হাতে ওটা পড়ার অর্থ চিরকালের জন্য আমেরিকানদের হাতে চলে যাওয়া । এই ফর্মুলাকে নিজেদের দেশে কাজে লাগিয়ে খাদ্যের উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিয়ে গোটা বিশ্বকে চাপের মধ্যে রাখতে পারবে আমেরিকা, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে । চাল-গম দেয়ার নাম করে তাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পাঁরবে।

গোপনে নিজের আবিষ্কারের খবর বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন সৈয়দ আবেদুর রহমান। গবেষণার কপি বাংলাদেশকে দিতে চেয়েছেন। ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এদেশের সরকার। কয়েক ধাপে ফর্মুলাটা দেশে নিয়ে আসার ভার পড়েছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের উপর । চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান দায়িত্বটা চাপিয়েছেন রানার উপর । তাই গ্রীষ্মকালে দেড়-দুই মাস ফ্রেডেরিকসবর্গে থাকতে হচ্ছে রানাকে । গত দুই বছর এসেছিল । এবারও এসেছে বুশ পাইলট সেজে এয়ার ট্যাক্সি চালানার ছুতোয় এখানে থাকে, ড. আবেদের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখে । সুযোগমত মিনি-সিডিতে করে ফমুলার একেকটা অংশ গোপনে রানার হাতে দেন তিনি । লন্ডনের রানা এজেন্সির মাধ্যমে রানা সেটা দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

ফেডেরিকসবর্গে প্লেন আছে মোট দুটো। একটা রানার অটার আ্যামফিবিয়ান। পার্ক করা আছে কংক্রিটে তৈরি স্লিপওয়ের মাথায় । অন্যটা স্কি লাগানো একটা এয়ারমাখি।

সকাল প্রায় দশটা বাজে । রাতে দেরি করে শোয়ায় ঘুম ভাঙতেই দেরি হয়ে গেছে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল রানা ।

কিছুক্ষণ পর ঘরের দরজায় জোরে জোরে থাবা পড়ল ।

কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেডরুমে বেরিয়ে এল ও ।

দরজা খুলে উকি দিল ডিটা জুনো। মেয়েটা এক্কিমো হলেও ডেনিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, কফি, মিস্টার রানা?

মেয়েটার বয়েস পঁচিশ, গ্রীনল্যান্ডেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা, বিনুনি করা সুন্দর চুল, ঠেলে বেরোনো চোয়াল–এস্কিমোদের যেমন থাকে, আর এস্কিমোদের মতই পটলচেরা চোখ। বছরের বেশির ভাগ সময় দাদা ডট জুনো সিনিয়রের ভেড়ার
খামারে ঘর সামলানোর কাজ করে। উপকূল ধরে প্রায় একশো মাইল গেলে স্যান্ডভিগ ভিলেজ, ওখানেই ওর দাদার খামার । গরমকালে একঘেয়েমি কাটাতে শহরে চলে আসে ও, হোটেলে চেম্বারমেইডের কাজ করে।

‘না, আজ চা-ই দাও, ডিটা,’ রানা বলল । ‘কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘হু, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শরীর খারাপ,” তিরস্কারের সুরে বলল ডিটা। “এত খাটেন কেন? অ্যা? শরীরকে মাঝে-মধ্যে বিশ্রাম দেয়া জরুরি ।’

হাসল’ রানা । ‘পুরোদস্তুর গিন্নি দাদাকেও সারাক্ষণ ধমকাও নাকি?

‘ধমক না খেলে পুরুষমানুষ ঠিক থাকে?’ গম্ভীর স্বরে জবাব দিল ডিটা। “কিন্ত আপনার চেহারাটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। আয়নায় দেখুন।’ ওর বড় ভাই ডট জুনোর বন্ধু এই মানুষটাকে ভীষণ পছন্দ করে ও। আর সে-জন্যেই একেবারে
বোনের মত খবরদারি করে।

রানা আর কিছু বলার আগেই একটা প্লেনের শব্দ সকালের নীরবতা ভেঙ্গে দিল। জানালা দিয়ে পলকের জন্য দেখা এয়ারমাখি প্লেনটাকে। ক্যানিং ফ্যাক্টরির ওপাশে ল্যান্ডিং স্ট্রিপে নামতে যাচ্ছে।

“ওই যে, তোমার বয়ফ্রেণ্ড এলো ।’

ডেভ? ডিটার গালে রঙ লাগল। জানালার কাছে গিয়ে দাড়াল।

রানাও এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্লেনটার তাকিয়ে আছে দুজনে । এয়ারমাখির নীচে লাগানো স্কি-র তলা দিয়ে চাকাগুলো বেরিয়ে আসছে ।

আমি ভেবেছিলাম গরমকাল এসে গেছে, স্কি খুলে নিয়ে আবার ফ্লোট লাগাবে ডেভ ।

শ্রাগ করল ডিটা। “ও, আপনি জানেন না? আমেরিকান মাইনিং কোম্পানির সঙ্গে ওর চুক্তির মেয়াদ বেড়েছে ।’

“তাই নাকি? ভাল।’

রানা জানে, ম্যালামাস্ক-এ সোনা-রূপার খনি খুঁজে বেড়াচ্ছে আমেরিকান একটা কোম্পানি । আইস-ক্যাপের কিনারের স্নোফিল্ড ছাড়া ল্যান্ড করার আর জাযগা নেই। আর সমতল বরফে ল্যাণ্ড করতে হলে স্কি দরকার ।

ভালভাবেই ল্যাণ্ড করল এয়ারমাখি। দক্ষ পাইলট ডেভ। এয়ারস্ট্রিপ ধরে ছুটে গেল।

গর্বিত হাসিতে উজ্জ্বল হলো ডিটার মুখ । রানাকে বলল, ‘আপনি শাওয়ার শেষ করুন, আমি আপনার চা নিয়ে আসি। তারপর নাস্তা দিতে বলব । বিছানাটা পরে সাট করব ।” ঘরের দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ও। |

আবার, বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে দাড়াল রানা। আরামদায়ক উষ্ণ পানি ওর উত্তেজিত স্নায়ুকে শীতল করে আনছে, মাথাব্যথাও কমে যাচ্ছে। ভালই হলো। একটু পর আড়াই ঘণ্টার একটা ফ্লাইট আছে।

সিল্কের পুরনো ড্রেসিং গাউনটা পরে বেডরুমে ফিরে এল ও । তোয়ালে দিয়ে জোরে জোরে ঘষে চুল মুছছে।

ও বাথরুমে থাকতেই ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম রেখে গেছে ডিটা ।

কাপে ফুটন্ত পানি ঢালল রানা । এক কাপ শেষ করে আরেক কাপ ঢালছে, এ সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল ডেভিড গোল্ডবার্গ ওরফে ডেভ।

উচ্চতা প্রায় রানার সমান, একআধ ইঞ্চি এদিক ওদিক হতে পারে । চুলের রঙ ফ্যাকাসে সাদা, তা-ই বলে বুড়ো হয়নি, রংই এমন। কপালে বলিরেখা নেই, একেবারে শিশুর মত সমান। ডেভের মত মেয়েপাগল পুরুষ কমই দেখেছে রানা এত দ্রুত প্রেমে পড়ে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেরিয়ে আসে–পারে কী করে, ভেবে অবাক হয় ও।

ফার-লাইন্ড্‌ বুট আর পুরনো ফ্লাইং জ্যাকেট পরা দেহটাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঝুঁকিয়ে হাতের ক্যানভাসের হোল্ড’ অলটাকে এক কোণে ছুঁড়ে দিয়ে টেবিলের দিকে এগোল ডেভ।

“আমি তো ভয়ই পাচ্ছিলাম তোমাকে ধরতে পারব কি না ভেবে। মনে করেছিলাম এতক্ষণে বেরিয়ে গেছ, রানাকে বলল ও । “সন্দ্রে স্টর্মফোর্ড থেকে এখানে আসার সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছি আমি আজ তোমার জন্যে ।’

“আমার জন্যে?

রানার কাপে চা ঢালা আছে সেটাই তুলে নিয়ে চুমুক দিল ও । ‘আজ তো তোমার সাপ্লাই নিয়ে যাবার দিন , ওই আমেরিকান অভিনেতাটার কাছে, তাই না?’

আমেরিকান অভিনেতা, মানে, গ্লেন রিভোল্টার। জুনের গোড়ার দিকে হঠাৎ করেই নিজের মোটর ইয়ট নিয়ে হাজির হয়েছেন গ্রীনল্যাণ্ডে। উদ্দেশ্য, মাছ ধরা আর শিকার করা | ইয়টটার নাম “আইসবার্গ’ ৷ রানা নিয়মিত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবার, ইত্যাদি পৌছে দিয়ে আসে ইয়টে ।
ডেভের প্রশ্নের জবাবে মাথা ঝাকাল রানা । “হ্যা, যাব। কেন? ,
“তোমার সঙ্গে আরও একজন যেতে চায়। কোপেনহেগেন থেকে এসেছে সুন্দরী, রাত দুপুরে নেমেছে সন্দ্রে এয়ারপোর্টে । সোজা গ্লেনের কাছে নিয়ে যেতে বলছিল আমাকে । রাজি হইনি । দুপুরের মধ্যে ম্যালামাস্কে যেতে হবে আমাকে, কিছু
স্পেয়ার পার্টস নিয়ে, জরুরি ভিত্তিতে আমেরিকা থেকে আনানো হয়েছে ওগুলো? তা গ্লেন এখন কোথায়?

‘শেষ খবর পেয়েছি ডিস্কোর উত্তরে নারকুয়াসিটের কোনখানে আছেন, শ্বেত ভালুকের খোজ করছেন ।’
বিস্ময় ফুটল ডেভের চেহারায় । “বছরের এই সময়ে ভালুক! রসিকতা করছ না তো?’
না ভাগ্য ভাল হলে পেয়েও যেতে পারেন এক আধটা। শুনেছি, আগস্ট মাসেও মাঝে মাঝে ভালুক আসে ওদিকে।’
“তা ঠিক, মাঝেসাঝে আসে, তবে সব বছর না।’
কী নাম তোমার সুন্দরীর? মেয়েটার প্রসঙ্গে ফিরে এল রানা ।
“আমার সুন্দরী নয়, গ্লেনের । রুথ । রুথ ম্যাককেইন।’
ভুরু উচু করল রানা। ‘ইজরায়েলি’
‘চেহারা-সুরতে তো ইংরেজ মনে হলো ।” হাসল ডেভ। “তবে তাতে কী যায় আসে বলো? জাত আর ভাষা যা-ই হোক, মেয়েমানুষ সব দেশেরই এক । তাই না?
“দেখতে নিশ্চয় ভাল?
মাথা ঝাকাল ডেভ।
নাচাল রানা । ‘কোথায় ও?

পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে ওর দিকে এগোল ডেভ। ‘ডিটা, সুইটহার্ট ।’

পাশ কেটে সরে গেল ডিটা। চাদরটা ফেলল বিছানায়। ‘আহ, বিরক্ত কোরো না তো।

ফ্লাইং জ্যাকেটের এক পাশের পকেটের জিপার খুলল ডেভ। “দেখো, তোমার জন্যে কী নিয়ে এসেছি।’ একতাড়া নোট বের করল ও। টাকা পেয়েছি, এইঞ্জেল। পুরো দু’হাজার ডলার। ওই আমেরিকানগুলো না থাকলে কি যে করতাম!

মুখ বাঁকাল ডিটা। ফ্রেডেরিক্সকোস্ট রেস্টুরেন্টে জুয়ো খেলে কত উড়িয়েছ? তাড়া থেকে দুটো একশো ডলারের নোট বের করে বাকি টাকা গুলো বাড়িয়ে দিল ডেভ। ‘নাও, রাখো, তোমার কাছে রেখে দাও ।”
লাভ কী? কালই তো আবার চাইবে।
হাসল ডেভ। “তা হলে ব্যাংকে তোমার আ্যাকাউন্টে রাখো । তা হলে আর সহজে হাতে পাব না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ।”
এই এক কথাতেই গলে গল ডিটা। সত্যি রাখব!
‘রাখবেই তো।’ ডিটার পিঠে আলতো চাপড় দিল ডেভ। “চলো, তোমাকে
এগিয়ো দিরে আসি ॥ এত টাকা নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া উচিত না তোমার।
রানার দিকে ফিরে চোখ টিপল ও। কোথায় যাচ্ছে, বুঝাতে অসুবিধে হলো না রানার । হয় নিজের ঘরে। নয়তো ডিটার। বেচারা ডিটা, ভাবল রানা । ডেভ যে ওকে ঠকাচ্ছে বুঝেও বোঝে না । সারাক্ষণ ডেভের প্রেমে বুঁদ । তবে ডেভের হাতে এখনও যে দু’চার থাকে, সেটা ডিটারই কারণে ।
বেরিয়ে গেল দুজনে।
কাপড় পরে নীচে রওনা হলো রানা।

সকালের এই সময়টায় রেস্টুরেন্ট প্রায় খালিই থাকে । রাস্তার দিকে মুখ করা বড় জানালার ধারে বসে কফি খেতে দেখল রানা মেয়েটাকে । খুবই সুন্দরী ৷ ইহুদি না ইউরোপিয়ান, চেহারা দেখে বোঝা যায় না। টুকটুকে লাল ঠোঁট, ধারাল চিবুক, ধোঁয়াটে চোখ, কাঁধে নেমে যাওয়া কালো চুল; সব মিলিয়ে কোন দেশের রানী না হলেও ছবির নায়িকা হওয়ার উপযুক্ত, তাতে সন্দেহ নেই।

ওর দিকে এগোল রানা ॥ সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকাল মেয়েটা। শান্ত ভঙ্গি। কালো চোখের তারায় কোনরকম উত্তেজনা নেই।

টেবিলের কাছে দাড়াল রানা । হাত পকেটে ঢোকানো । মিস ম্যাককেইন? আমি মাসুদ রানা শুললাম, গ্লেন রিভোল্টারের খোঁজ করছেন। কেন, জানতে পারি?

শান্ত ভঙ্গিটা আর শান্ত থাকল না, সামান্য অবাক মনে হলো মেয়েটাকে । “দরকার আছে?

ওর দরকার থাকতে পারে।

টেবিলের উল্টো দিকে চেয়ার টেনে বসল রানা । রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো ওয়েইটারের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। হটপ্লেট ‘থেকে তিমির মাংসের কাবাব বের করে এনে রানার সামনে টেবিলে রাখল ও ।

‘আপনি মনে হচ্ছে ওর গার্জেন?’

“দেখুন, শান্তকন্ঠে জবাব দিল রানা, ব্যাপারটা খুলেই বলি, গ্লেন চান না, কেউ ওঁকে বিরক্ত করুক। সপ্তাহে একবার ‘করে সাপ্লাই নিয়ে যাই আমি ওঁর ইয়টে । আমার যা ভাড়া, তার দ্বিগুণ দেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে, নগদ ডলারে । কোন বোকামি করে এ ধরনের একজন কাস্টোমারকে হারানোর আগে দশবার চিন্তা করব আমি ।

“যদি বলি গ্লেন আমার পুরনো বন্ধু

“কী করে বুঝব?

“জানতাম এই জবাবই দেবেন, হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা ওয়ালেট বের করল মেয়েটা । ‘আমি যদি যাই, আপনাকে প্লেন ভাড়া কত দিতে হবে?

‘পাচশো ক্রোন।’

“আমেরিকান ডলারে কত হয়?’

প্রায় দেড়শো ডলার।’

তিনটে নোট বের করে টেবিলের উপর দিয়ে ঠেলে দিল মেয়েটা । “তিনশো দিলাম । আসা-যাওয়ার ভাড়া । ফিরতি ভাড়াটাও দিয়ে রাখলাম, কোন কারণে যদি গ্লেন আমাকে পছন্দ না করে, বিরক্ত হয়ে ফেরত পাঠায়, সেজন্যে । কী, ঠিক আছে? তাতে আশা করি আপনার কাস্টোমার নষ্ট হবে না?’

“এখনও বলতে পারি না। সব কিছুই নির্ভর করে গ্লেনের মেজাজ-মর্জির ওপর, টাকাগুলো নিজের ওয়ালেটে ভরল রানা। “চল্লিশ মিনিটের মধ্যে রওনা, হচ্ছি আমরা আবহাওয়া ঠিক থাকলে দু’ঘণ্টা লাগবে যেতে ।’
“আমার কোন অসুবিধে”নেই ।’

উঠে দাঁড়াল রুথ। ইটালিয়ান মেয়েদের মত লম্বা নয়, পাঁচ ফুট তিন কি চার। পরনে দামি টুইডের সুট, পায়ে নাইলনের মোজা, আর পিগস্কীনের তৈরি ফ্ল্যাট জুতো।

“আরেকটা কথা, রানা বলল, “উইকএন্ডে বেড়ানোর জন্যে এ প্রোশাক ঠিক আছে, কিন্তু যেখানে যাচ্ছি আমরা, তার জন্যে আলাদা পোশাক লাগবে ।’

“বেশি ঠাণ্ডা? জবাবের অপেক্ষা না করে মেয়েটা বলল, “বেশ, কাপড় বদলে নেব । তবে একটা কথা না বলে পারছি না, গ্রীনল্যাণ্ড দেখে আমি হতাশই হয়েছি ।’

“আপনি কী আশা করেছিলেন? সিলের চামড়ার পোশাক পরা মানুষ? আধুনিক আরামদায়ক পোশাক থাকতে ওগুলো পরতে যাবে কেন লোকে রানা বলল । “তাছাড়া উত্তাল সাগরে কাইয়াকের চেয়ে ডিজেল-মোটর লাগানো ওয়েইলবোট চালানোও অনেক সহজ, অনেক বেশি নির্ভর করা যায় ওগুলোর ওপর । তবে আপনি যা চাইছেন- রাফ আউটডোর-ডিস্কোতে গেলে আশা করি সেটা পাবেন ।’

‘দেরি করে লাভ নেই, শুকনো গলায় বলল রুথ । “কাপড় বদলাব কোথায়?

“আমার ঘরেই চলে যান। দোতলায়, একুশ নম্বর । আমি নাস্তা সেরে নিই। আরও, দু’চারটা টুকিটাকি কাজ আছে। আধঘন্টার মধ্যেই আপনাকে তুলে নেব আমি।

বেরিয়ে গেল রুথ। দরজার বাইরে দাড়িয়ে পোর্টারের সঙ্গে কথা বলল। তাড়াহুড়া করে গিয়ে দেয়ালের পাশে রাখা সুইটকেসটা তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল পোর্টার। পিছন পিছন চলল রুথ ৷ তাকিয়ে আছে রানা । মেয়েটাকে চেনা
চেনা লাগছে ওর । কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায়, মনে করতে পারছে না।

মেপে মেপে পা ফেলে রুথ, সারা দেহ দুলিয়ে, বিশেষ একটা ছন্দে ।

এতক্ষণে প্লেটের দিকে তাকানোর সুযোগ পেল রানা । কাবাব ঠান্ডা হয়ে গেছে। এ আর খাওয়া যাবে না। প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে কফির কাপ তুলে নিল । চুমুক দিতে দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, চওড়া রাস্তা ছাড়িয়ে বন্দরের দিকে, যেখানে রোদে চকচক করছে ওর অটার প্লেনটা টকটকে লাল আর রূপালী রঙ করা । চোখ অন্যদিকে থাকলেও মন জুড়ে রয়েছে রুথ। কোথায় দেখেছে ওকে? কেন পরিচিত লাগল?


হোটেলের ল্যাগু-রোভারটা ধার নিয়ে বন্দরে চলল রানা । মূল কাজ, হার্বার মাস্টারের অফিস থেকে আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করা । আগের রাতেই প্লেনে তেল ভরে রেখেছে, কাজেই ওই ঝামেলাটা শেষ। আর রয়্যাল গ্রীনল্যাণ্ড ট্রেডিং কোম্পানির কাছে এতটাই দামি কাস্টোমার হয়ে উঠেছে গ্লেন রিভোল্টার, ওর স্কচের বাক্স থেকে শুরু করে সমস্ত রসদপত্র প্লেনে তুলে দেয়া ও তদারকির ভার কোম্পানির লোকই নিয়েছে, তাই ওই কাজটা নিয়েও মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন হয় না রানার।

হোটেলে ফিরে উপরতলায় উঠে এল ও। বেডরুমে ঢুকে রুথকে দেখল না। বাথরুম থেকে শাওয়ারের শব্দ আসছে। ড্রেসিং রুমে এসে কাপড় বদলাতে শুরু করল রানা ।

ফ্লাইং বুট পরছে, এ সময় বাইরের দরজা খোলার শব্দ হলো । কেউ ঢুকেছে। সোজা হলো রানা । ওর নাম ধরে ডাকতে শুনল ডেভকে। বেডরুমে ঢুকে বাধা দিতে দেরি করে ফেলল রানা। বাথরুমের দরজা খুলে ফেলেছে ডেভ। ভিতরে
তাকিয়ে ধাক্কা খেয়ে যেন পিছিয়ে এল। মুহূর্ত পরেই “দরজায় দেখা দিল রুথ, বড় একটা সাদা বাথ টাওয়েলে গা ঢাকা।

“কী ব্যাপার? আগুন ঝরছে ওর চোখ থেকে রানার দিকে তাকিয়ে বলল, “দয়া করে এই ভদ্রলোকটাকে আরেকটু ভদ্র হতে বলবেন?

হা করে তাকিয়ে আছে ডেভ। ওর মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিল রুথ।

ডেভের কাধে টোকা দিল রানা । “কেটে পড়ো, ডেভ।”

‘কী শরীর, আহা! ফিসফিস করে বলল ডেভ। ‘এত নিখুঁত! এত সুন্দর আমি জীবনেও দেখিনি!

“দেখেছ, রানা বলল। তিন হাজার সাতচল্লিশ বার। ডেভকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে করিডরে বের করে দরজা লাগিয়ে দিল ও ড্রেসিং রুমে ফিরে একটা সোয়েটার গায়ে দিল। তার উপর চড়াল একটা ফারলাইন “হুডওয়ালা, সবুজ রঙের পুরনো পারকা। আবার “যখন বেডরুমে ফিরল, রুখ তখন ড্রেসিং রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।

স্কি প্যান্ট, কসাক বুট আর ভারী নরউইজিয়ান সোয়েটার পরেছে।

আসলে ডেভের কোন দোষ নেই, রানা বলল । ‘ও ভেবেছিল বাথরুমে আমি। কোন কু-মতলব ছিল না ওর।

সে তো কারোরই থাকে না!

খোলা সুটকেসের পাশে বিছানায় একটা ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পড়ে রয়েছে। তুলে নিল রুথ। পরতে শুরু করল। ওর দিকে থাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার ভাবল রানা–পরিচিত লাগছে কেন ওকে?

‘আগে আপনাকে কোথায় দেখেছি, বলুন তো?’ জবাবটা না জেনে স্বস্তি পাচ্ছে না রানা । “ছবিতে নয় তো?’ জ্যাকেটের
বোতাম লাগানো শেষ করল রুথ। আয়নায় ভালমত দেখল নিজেকে। আবার চিরুনি চালাল চুলে। সিনেমায়।
বলতে বলতেই মনে পড়ে গেল ওর। “হ্যা হ্যা, এবার চিনেছি। ওর শেষ ছবিটায় একটা অ্যালজিরিয়ান মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
মারদাঙ্গা ছবি।
‘মারদাঙ্গা হলেও ভাল চলেছিল ছবিটা, অতীতের কথা ভেবেই বোধহয় উজ্জ্বল হলো রুথের মুখ। সুটকেসের জিপার লাগাল।, “কেমন লেগেছিল?” দারুণ রানা বলল। ‘সাংঘাতিক। গ্লেনের তো ফাটাফাটি অভিনয় ।’
আর আমার?

‘খুব ভাল।

“যাহ, মিছে কথা বলছেন। রুথের মুখ দেখেই বোঝা গেল রানার প্রশংসায় খুশি হয়েছে ও।

নানা, সত্যিই ভাল হয়েছে।’

‘থ্যাংক ইউ ।” সুটকেসটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল রুথ। পিছনে চলল রানা ।

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top