কায়রো – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Cairo – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

“বসো ।’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ।

বসে পড়ল রানা।

“মন দিয়ে শোনো…”

মন দেয়ার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু পারা যাচ্ছে না। মন পড়ে আছে পাশের ঘরে। বহু কষ্টে টেনে-হিচড়ে নিয়ে এল সে সেটাকে পুরু কাচঢাকা প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপাশে চেয়ারে ঝজু ভঙ্গিতে বসে থাকা প্রবীণ লোকটির কাছে। কাচা-পাকা ভুরুর নিচে তীক্ষ দুটো চোখের দিকে একটিবার তাকিয়েই জিভটা শুকিয়ে এল ওর। হিম হয়ে এল বুকের ভিতরটা । ব্যাপার গুরুতর ।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।

“তুমি জানো, আল-ফাত্তাহকে সাহায্য করছি আমরা। দুশো তেইশজন পাকিস্থানী ইউরোপ ও মিডলইস্টে কাজ করছে আল-ফাত্তাহর হয়ে। আল-ফাত্তাহর কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ অনুরোধে আমাদের সেরা ছয়জন এজেন্টকেও পাঠিয়েছিলাম পি.সি.আই থেকে। এদের নেতা হিসেবে গিয়েছিল মেজর আহসান ।”

‘আহসান?

হ্যাঁ। আমাদের মিডল-ঈস্ট এজেন্ট।’ দামী ব্রায়ার পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন বৃদ্ধ। নীলচে-সাদা ধোয়া থ্রী-নানসের সুবাস নিয়ে এল রানার নাকে। সিগারেটের তেষ্টা পেল ওর! “আহসানের পোস্টিং হয়েছিল কায়রোতে । কথাটা বলে চুপচাপ কিছুক্ষণ পাইপ টানলেন তিনি। চোখ দুটো রানার মুখের ওপ স্থির হয়ে আছে। অন্যমনস্কভাবে চেয়ে আছেন বৃদ্ধ ভুরু কুচকে। দূর থেকে এই অবস্থায় হঠাৎ কেউ দেখলে মনে করবে ভয়ানক বকাঝকা করছেন তিনি রানাকে। উঠে দাড়ালেন বৃদ্ধ একটু চমকে গেল রানা । উঠতে যাচ্ছিল- বাম হাতের আবছা ইশারায় বসে থাকবার নির্দেশ দিলেন তিনি। দেয়ালে টাঙানো দশ ফিট বাই ছয় ফিট ওয়ার্লড ম্যাপের সামনে গিয়ে দাড়ালেন। পাইপের মুখটা গিয়ে ঠেকল যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাংশে আটলান্টিক মহাসাগরের কোন একটা জায়গায়। “নিউ ইয়র্ক থেকে গত মে মাসের তিন তারিখে একটা জাহাজ ছেড়েছিল। ইসরাইলের জাতীয় শিপিং করপোরেশনের জাহাজ । যাত্রী ছিল প্রধানত আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছা-সেবক বাহিনী এবং জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কিছু লোক। এরা আসছিল ইজরাইলের নতুন আক্রমণ পরিকল্পনা কার্যকরী করতে। জাহাজে ছিল প্রচুর অস্ত্র, গোলা-বারুদ আর যন্ত্রপাতি । এ জাহাজ ধ্বংস করে দেয়ার প্ল্যান নেয় আল-ফাত্তাহ। কিছু আরব এবং দু’জন পাকিস্তানী ঢুকে পড়ে ইহুদি স্বেচ্ছা-সেবক বাহিনীর মধ্যে। পরিকল্পনা অনুসারে ভূমধ্যসাগরের প্রবেশ-মুখেই জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু-ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন বৃদ্ধ। বিশ সেকেন্ড নীরবতা । তারপর কথাটা শেষ করলেন। “জাহাজটা নির্বিঘ্নে তেল-আবিব পৌছেচে। স্পাইরা ধরা পড়েছে । এ ছাড়াও এ-ধরনের আরও ঘটনা ঘটেছে । পরপর কয়েকটা পাকিস্তানী মিশন ব্যর্থ হয়েছে তেল-আবিবে।’

আবার নীরবতা । নিভে যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে নিয়ে একটানা আধ মিনিট টেনে চললেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। রানা লক্ষ করল কপালের একটা ধমনী টিপ টিপ করে কাপছে বৃদ্ধের । দৃষ্টি রানার পিছনে দেয়াল ঘড়িটার উপর আবদ্ধ।

“চাকরি?’ প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ ।

“পেয়েছি ।’
আরো কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হলো রানা। চোখের দিকে থাকিয়ে নির্দেশ পেল । বলতে লাগল, “সোনালী প্রোডাক্টসের কায়রোর প্রতিনিধি বিনা নোটিশে চলে এসেছে । আমাকে অফিসের ভার আগামী সাতদিনের মধ্যেই নিতে হবে । আমি–”’

পাইপ নেমে গেল।

“তুমি আজ রাতের ফ্লাইটে রওনা হচ্ছ।’

চট করে চাইল রানা সেই চোখের দিকে । ঠিকই দেখল, ওখানে বিপদ-সঙ্কেত।

আমাদের ছয়জন এজেন্ট ছিল কায়রো, এথেন্স, জেনেভা, ত্রিপোলী আর খোদ তেল-আবিবে। আহসানই এদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত । এরা সবাই চারদিক থেকে তেল-আবিবের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার এবং
মূল তেল-আবিবে ঢুকবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। প্রথম দিকের সাফল্য আল-ফাত্তাহ কমান্ডার আরাফাতকে আশ্চর্য করে দেয়। তিনি আমাদের কংগ্রাচুলেশনও জানিয়েছিলেন। কিন্ত্ব–” একটু থেমে বৃদ্ধ বললেন, “এখন প্রায় প্রত্যেকটি পরিকল্পনা কোথা থেকে যেন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে । প্রত্যেকটা দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ থমকে
গেলেন বৃদ্ধ। কিছু ভাবছেন। অন্যমনস্ক।

উঠে দাড়ালেন।

“সময় নেই হাতে । তোমাকে যেতে হচ্ছে কোথা থেকে ফাঁস হয়েছে খবর তা জানতে । এথেন্স থেকে জাহেদই তোমাকে চেয়ে পাঠিয়েছে । আমিও মনে করি…” কি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন বৃদ্ধ ।

সামনের ফাইলগুলো এক এক করে এগিয়ে দিলেন রানার দিকে । কোনটা আহসানের শেষ রিপোর্ট । কোনটা এজেন্ট কো-অর্ডিনেটরদের পরিচয়। সিক্রেট নাম্বার। ইত্যাদি ।

সিক্রেট নাম্বার? রানা অবাক হলো।

“এ মিশনে তোমাকে সিক্রেট নাম্বার ব্যবহার করতে হবে-সাবধানতার জন্যে । তোমার সিক্রেট নাম্বার এম-আর নাইন । কায়রোতে তোমার সঙ্গে দেখা করবে জাহেদ ।’

মেজর জেনারেল বসলেন।

‘স্যার, বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে থমকে গেল রানা। বৃদ্ধ রানার দিকে তাকালেন। একটু যেন থতমত খেয়ে ফাইল উল্টিয়ে চলল রানা । আহসানের ফটোগ্রাফের উপর চোখ থেমে গেল। রানা দেখল বন্ধু মেজর
আহসানকে।

চোখ তুলে আবার তাকাল বৃদ্ধের চোখে । বলল, “বিশ্বাসঘাতক কে?’

“সেটা তুমিই বের করবে ।” পরিষ্কার উচ্চারণ জলদকণ্ঠে।

“আপনি আহসানকে সন্দেহ করেন? রানার প্রশ্নটা রূঢ় শোনাল।

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। বললেন, না” উঠে দাড়ালেন। রানা দেখল, জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি, একটু স্তিমিত হয়ে গেল যেন। রানাও উঠে দাড়াল। বৃদ্ধ বললেন, “আহসানকে হত্যা করা হয়েছে ।’ “আহসান! অস্ফুটে উচ্চারণ করল রানা ।

চোখ আপনা থেকে নেমে গেল আহসানের ছবির উপর। চওড়া কপাল, খড়গের মত নাক, চোখে সেমিটিক বৈশিষ্ট্য । ওর ধমনীতে ছিল আরব রক্ত । ও বলত, প্যালেস্টাইন আমার পূর্ব-পুরুষের বাস, ওটা আরবদের- ইউরোপীয়দের
কোন অধিকার নেই আরব-ভূমির ওপর।

দুই

কায়রো এয়ারপোর্টে নামল বি.ও.এ.সি, বোয়িং।

এয়ার টার্মিনালে সব ঝামেলা চুকিয়ে ট্যুরিস্ট ব্যুরোর কাউন্টারে পৌছতেই পাশে এসে দাঁড়াল এক কালোকেশিনী। এক নজরে মেয়েটিকে পুরোপুরি দেখে নিল রানা । সুন্দরী, এক কথায় বলা যায়। একটু ভারী গড়ন। ভারী, ঘুম-ঘুম মুখশ্রী।
কালো, লালচে-কালো চুল্‌। ফর্সা মুখকে ব্যাকেটে বন্দী করেছে। সবুজ চোখ। ছোট্ট একটা নাক, ভারী ঠোঁট। মুখের এই গড়নের জন্যই মেয়েটিকে ভারী মনে হয়েছিল। আরও দু’পা এগিয়ে এলে রানা দেখল, ভারী ঠিকই, প্রয়োজনীয় জায়গায় ভারী। প্রয়োজনীয় বঙ্কিম রেখাসমৃদ্ধ দেহ।

সুবক্র মেয়েটি ইংরেজিতে করল, “আপনি কি মাসুদ রানা?

রানা বলল, হ্যা ।’
ফয়সল। ওয়েল কাম টু কায়রো ।’

হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটি, ‘আমি ফায়জা।’ একটু থেমে বলল, ‘ফায়জা ফয়সল। ওয়েলকাম টু কায়রো।’

টু অ্যারাব,’ রানা বলল। “আপনি সোনালী জুট প্রোডাক্টসের–.?”

“হ্যা, আপনি আমার নতুন বস্।’ একটু এগিয়ে বলল, “আসুন ।’

বাইরে দু’জন এসে দাঁড়াল একটা কালো রঙের মস্কোভিচের সামনে । গাড়ির দরজা খুলে ধরল মেয়েটি। রানা ব্যাক সিটে হাতের ব্যাগ, সুইটকেস ছুঁড়ে দিয়ে উঠে বসল। মেয়েটি ড্রাইভিং সীটে বসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোন বিশেষ হোটেলের সঙ্গে কথা বলেছেন?

“সেমিরেমিস হোটেল- আমার পছন্দ ।’
“আপনি আগেও এখানে এসেছেন বুঝি?

‘না, রানা বলল, “আমি গাইড বুকের সিরিয়াস পাঠক ।’

মেয়েটি আরও একবার তাকাল মুখ ঘুরিয়ে । হাসল, সুন্দর দাতগুলো বেরিয়ে পড়ল। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করে থামল। হাতের ব্যাগ বের করল গাড়ির গ্রাভস-কম্পার্টমেন্ট থেকে । গোলাপী রঙের একটা স্কার্ফ বাধল মাথায়। চোখে গোলাপী ফ্রেমের গগলস্‌ জুড়ল।

রানা জিজ্ঞেস করল, ‘কায়রো শহর এয়ারপোর্ট থেকে কতদূর?’

‘ষোলো মাইল’, বলেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যেই স্পীড মিটারের কাঁটা ষাট মাইলের কৌঠায় পৌছে গেল।

“টেলিগ্রাম পেয়েছি আজ সকালে, মেয়েটি বলল। “শুনেছিলাম আপনি এক সপ্তাহের মধ্যে আসবেন ।’

“একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম, রানা বলল। “আমি একটু বেশি উৎসাহী লোক।’
আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে,’ ফায়জা হাসল। “আমি উৎসাহী লোক পছন্দ করি।’

কথা বলার ফাঁকে রিস্টওয়াচে বাংলাদেশের সময়টাকে রানা মিশরীয় করে নিল ফায়জার বিশাল অটোমেটিক ঘড়িটা থেকে ।

এখন সন্ধ্যা লেগে আসছে কেবল।

ধূসর-গোধূলির কথা ভাবতে গিয়ে হোচট খেলো । শহরে প্রবেশ করল গাড়ি।
শারা আল গাইস থেকে গাড়ি শারা আল খালিলে পড়ল । সাজা হয়ে বসল রানা । কেননা মেয়েটি অন্য পথ ধরেছে । এবং শারা আল আজহার ধরে পুব দিকে এগুচ্ছে । অথচ হোটেল সেমিরেমিস দক্ষিণে, নীল নদের তীরে।

হোলস্টারের অনুপস্থিতি অনুভব করল রানা । সে নিরন্ত্র। পিস্তল নিয়ে এলে অনেক ঝামেলা। গাড়ির মুখ ঘুরাবে কি না ভাবতে গিয়ে, হঠাৎ বলল, এখানে একটু রাখুন।’

হার্ড ব্রেক কষল ফায়জা। গাড়ি থেকে নেমে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে সিগারেট কিনল রানা। দোকানিকে জিজ্ঞেস করে ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়েল করল একটা বিশেষ নাম্বারে । সাড়া পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “রূম নাম্বার সিক্স? এম.আর.নাইন।’ আরবীতে বলল কথাগুলো । বলে চলল, “আমি আল আজহার রোডের উপর দিয়ে যাচ্ছি। কালো মস্কোভিচ। নাম্বার: কায়রো দুই সাত তিন পাচ… কথা শেষ হতেই জবাব হলো, “আমাদের লোক আপনার কাছাকাছিই আছে,” রানা অবাক হয়ে ফোন রেখে দিয়ে ফোনের চার্জের কথা জিজ্ঞেস করল ইংরেজিতে । কেননা স্টোরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে ফায়জা। সেল্স গার্ল অবাক হয়ে থাকাতেই রানা পকেট থেকে দশ পিয়ান্তারের নোট কাউন্টারে রেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ফায়জা মৃদু হেসে সেল্স গার্লের হাত থেকে নোটটা নিয়ে ব্যাগ থেকে একটা কয়েন বের করে কাউন্টারে দিল। দোকানি মেয়েটা রানা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল: “কোথেকে এসেছে? ফায়জা বলল, “পাকিস্তান ।’ উত্তরে সেল্স গার্ল হাসল, “কিন্তু ভদ্রলোক আরবদের মত আরবী বলেন।’ “এখানে প্রতি টেলিফোন কলের জন্যে লাগে এক পিয়ান্তার ৷

ফায়জা রানার কাছে এসে দশ পিয়ান্তারের নোটটা ফেরত দিয়ে বলল, এখানে প্রতি টেলিফোন কলের জন লাগে এক পিয়ান্তার। “খুব বেশি না, রানা ইংরেজিতেই বলল, “আমাদের দেশের হিসেবে পনেরো পয়সা ।

গাড়িতে ফিরে মেয়েটি ড্রাইভিং সীটে বসল না। রানা হেসে ড্রাইভিং সিটে উঠে সেলফ স্টার্টার চেপে স্টার্ট দিয়ে তাকাল ফায়জার দিকে। ফায়জা দৃষ্টি তখন একটা দোকানের শো-কেসে।

রানা জিজ্ঞেস করল, “কোনদিকে যাব?’

ফায়জা মুখ ফেরাল। গম্ভীরভাবে বিশুদ্ধ আরবীতে বলল, “কায়রো আপনার অপরিচিত নয়। যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারেন।’

ইউ টার্ন নিয়ে পুরানো পথেই ফিরে চলল রানা । এবং আরবীতে বলল, কায়রো আমার চেনা কিন্তু কায়রোর অচেনা মেয়েকে যে ড্রাইভিং সিটে বসতে দিতে নেই এ শিক্ষা আমার হয়েছে ।’ আল আজহার থেকে বা দিকে শারা আব্দ
আল আজিজ-এ টার্ন নিতেই ফায়জা বলল, “আমি এখানেই নামব।’

গাড়ি ব্রেক করে রানা ফায়জার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। বলল, ‘আমি অচিন দেশে বিদেশী…’ “এটা আপনার জন্যে অচিন্-পুরি নয় ।’ নেমে পড়ল ফায়জা । রানাও নামল। বলল, ‘কিন্তু মাঝপথে…তাছাড়া তোমার গাড়ি…’

ওটা আপনার গাড়ি। সোনালী জুট প্রোডাক্টসের সম্পত্তি। ফায়জা দু’পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ব্যস্ত রাস্তার পিছনে একটা নীল সিট্রোন দেখিয়ে বলল, “আপনার বন্ধুরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’

রানা চমকে তাকাল । মেয়েটাও লক্ষ্য করেছে । এবার ভাল করে নিরীক্ষণ করে দেখল মেয়েটিকে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে । কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিল সে আল-ফাত্তাহর যোগাযোগ দফতরে । এ দফতরকে আল-ফাত্তাহর বৈদেশিক-দপ্তর বলা যেতে পারে। এরা বিদেশ থেকে আগত আল-ফাত্তাহর সদস্যদের সহযোগিতা করে।

নীল গাড়িতে একটা লোক বসে- মাথায় মস্ত টাক। অনেকটা বুলেটের মাথার মত। লোকটা এদিকেই তাকিয়ে আছে । রানাকে চোখ ফেরাতে দেখেই গাড়িটা এগিয়ে গেল।

রানা সোজা গাড়িতে উঠে রাস্তার ব্যস্ততায় মিশে গেল। বেশ দ্রুত চালিয়ে কিছুদূর এসে দেখল গাড়িটা তার পেছনেই আসছে। বুস্তান রোডে টার্ন নিল। আল তাহবিরের মোড়ে, যেখানে সাতটা রাস্তা একখানে মিশেছে-সোজা না গিয়ে পুরানো কায়রো যাবার পথটা ধরল- ডানে মিশর সরকারের দফতর, বামে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি রেখে পার্লামেন্ট ভবনের সামনের রাস্তা ধরে নীল নদের দিকে এগোল। কিছুদূর আসতে পাওয়া গেল সামনে নীল নদ, ডানে হোটেল
সেমিরেমিস।

হোটেল সেমিরেমিস এর পাঁচতলায় রানার স্যুইটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় নীল নদ। নীলের এখানে দুটো দ্বীপ । গেজিরা আর মানজেল। হোটেলের সামনেই গেজিরার সঙ্গে মূল কায়রোকে যুক্ত করেছে তাহরির ব্রীজ।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

কায়রো কত বদলে গেছে । সাত বছর আগে দেখা কায়রোকে তবু চিনি, রানা ভাবল। হাসি পেল। কত সহস্র বছরের সভ্যতার ইতিহাস বহন করে নীলের এই পলিভূমি-সাত বছর সেখানে কি!…”‘ভাবনাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল ফোন।

ফোন?

কে করবে তাকে ফোন-এত তাড়াতাড়ি?

ব্যালকনি থেকে ঘরে এসে রিসিভার তুলে নিল রানা । কিছু বলল না।

“এম-আর নাইন?’ কণ্ঠ ভেসে এল।

উত্তর দিল না রানা ।

“রুম নাম্বার সিক্স থেকে বলছি, কর্নেল সিক্স ।’

রানা বলল, “আমি নিরাপদেই আছি ।’

‘আমি জানি, গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। “এই নাম্বারটা টুকে নিন।’ একটা নাম্বার বলল।

রানা নাম্বারটা রিপিট করে জিজ্ঞেস করল, কার নাম্বার?

“জিসান বাট। ডক্টর। আহসানের বান্ধবী। আপনার জিনিস আটটায় ডিপার্টমেন্ট থেকে নিয়ে নেবেন ।’ কেটে গেল লাইন। .

রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াল রানা ! জিসান বাট। জিসান…ভাবতে ভাবতে ঘরের মধ্যে কাপড় ছেড়ে শাওয়ারের নিচে দাড়াল । ভাবল নামটাকে। জিসান বাট…জিসান…কর্নেল সিক্স ।

পাঁচ মিনিট পর বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে । রূম নাম্বার সিক্সের দেয়া নাম্বারে ডায়াল করল ।

তিনবার রিং হলো। তারপর কেউ রিসিভার তুলল ।

শোনা গেল ইংরেজিতে সুললিত উচ্চারণ, “ডক্টর বাট বলছি।’

রানা, মাসুদ রানা—সদ্যাগত বাঙালী ।’ একটু থেমে বলল, ‘আজ আপনার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

“রোগীর সঙ্গে দেখা আমি চেম্বারেই করে থাকি, আপনি আটটার মধ্যে এলে…”

“আমি অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান বাঙালী, রানা বলল। “আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে চাই। আহসান আমার বন্ধু ।

“আহসান!” ওদিকে অস্ফুট উচ্চারণ শোনা গেল ।

“হ্যা, পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং-এ ছিল, রানা বলল। “তার মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি–আপনি বোধহয় কিছু বলতে পারবেন । “না, আমি কিছু জানি না। জানলে… থেমে গেল কণ্ঠস্বর । তারপর আবার শোনা গেল, ‘আহসানকে আমি বুঝতে পারিনি । ও আমাকে বুঝতে দেয়নি । দিলে সম্পূর্ণ ঘটনা হয়তো অন্যরকম হত ।’
হয়তো হত। হলে আপনার মত আমিও সুখী হতাম, রানা বলল। “কিন্ত হয়নি।’

হ্যা, হয়নি।

একটু চুপ করে রইল রানা । ওপাশের কণ্ঠ বলল, “আপনি কোথেকে বলছেন?

“হোটেল সেমিরেমিস।’

শেরিফ পাশা রোডে “হোয়াইট নাইল” রেস্তোরায় আমি থাকব ঠিক সাড়ে ন’টায়। একটু আগে যাবেন আপনি। আপনার নাম কাউন্টারে বলে রাখবেন ।’ রিসিভার রেখে দিয়েছে জিসান, ডক্টর জিসান বাট ।

সুটকেস থেকে সব পোশাক বের করে ওয়ারড্রোবে রাখল রানা একজন বেলবয়ের সাহায্যে।

পরল , ডার্ক-ব্লু স্যুট, হালকা নীল শার্ট, কালো টাই, কালো মোকাসিনশ। বাঁ পা তুলে হিল ঘুরিয়ে লন্ডনের উইলকিনসন সোর্ড লিমিটেডের তৈরি পাতলা স্টীলের চুরির অস্তিত্বটা দেখে নিল। আপাতত এটাই তার একমাত্র সম্বল।

ঘর থেকে বেরুল রানা সাড়ে আটটায়। মস্কোভিচ ছুটল নাইলের পাশ দিয়ে। ছাব্বিশে জুলাই ব্রিজের কাছে গেজিরা প্যালেস হোটেলের সামনে দিয়ে হাজির হলো একটা হলুদ রঙের বাড়ির সামনে । মেজর জেনারেলের নির্দেশ মতই পেয়ে গেল একটা সাইন বোর্ড । ‘আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘ” । তেতলায় অফিস। সিড়ি ধরে সোজা উপর তলায় উঠতে লাগল রানা । তেতলায়-সিড়ির সঙ্গেই একটা সবুজ দরজা । সেখানে আরবী, ইংরেজিতে লেখা রয়েছে “লেখক সংঘ’ । হাতল ধরে চাপ দিতেই দেখল খোলা । ঢুকে পড়ল । একটা লম্বা করিডর। দু’পাশে অনেক দরজা । দরজায় সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট পদ-বাচ্য অনেক নাম দেখতে পেল।

রূম নাম্বার সিক্স– কনফারেন্স রূম।

নক করল আস্তে করে। কি নীরব চারদিক! দরজা খুলে গেল । সামনে দাঁড়িয়ে ভূমধ্যসাগরের গভীর অন্ধকারে দু’টো সার্চ লাইট যেন! কালো পোশাক পরা, চুলে মুখ ঢাকা একটি মেয়ে এবং তার চোখ । চোখ দুটো তাকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে প্রায় বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “আসুন।’

দরজা খুলে গেল আরও খানিকটা । ভিতরে গেল রানা । মেয়েটি -দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেল।

সামনে তাকাল রানা ।

বিরাট ঘর। অন্ধকার-প্রায়-শুধু এককোণে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একটা উজ্জল টেবিল–সেখানে দ্বিতীয় মানুষের অস্তিত্ব । কর্নেল সিক্স। আল-ফাত্তাহর বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান। অন্য আল-ফাত্তাহদের চেয়ে এরা একটু গোপনীয়তা বজায় রাখে বেশি রকমের। কারণ এদের কাজ করতে হয় বিদেশীদের সঙ্গে । এরা বিদেশে লোক পাঠায় বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

একভাবে তাকিয়ে আছে কর্নেল সিক্স।

এগিয়ে গেল রানা ।

টেবিলের কাছে আসতেই -শুনল, “বসুন।’ ,

বসার আগে লোকটাকে ভাল করে দেখল রানা । মুখে দাড়ি, ছেঁটে রাখা। ভারী, চৌকো মুখ। পরনে আরবীয় পোশাক কিন্তু মাথা খালি। সেখানে একটি চুলও নেই । বয়স পঞ্চাশের উপর ৷ থুতনির কাছে দাড়িতে পাক ধরেছে। রানা টেবিলের এধারের দু’টি চেয়ারের একটিতে বসল।

গতকাল সিরিয়ার অফিস থেকে আপনার সুস্পর্ন রিপোর্ট পেয়েছি। লোকটি বলতে শুরু করল হটাৎ, নাটকীয়তা ছাড়াই । আপনি আহসানের মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করবেন এবং পাকিস্তানের আল-ফাত্তাহদের নেট-ওয়র্কে সম্প্রতি যে ভাঙন দেখা দিয়েছে সেটার কারণ বের করে সুষ্টভাবে পরিচালনার চেষ্টা করবেন। এটা আমরাও চাই। পাকিস্তান এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের স্বেচ্ছাবাহিনী সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ব্যর্থতা দেখিয়েছে । তেল-আবিব অভিমুখী প্রত্যেকটা অভিযান ব্যর্থ হচ্ছে। এরকম চলতে দিলে শক্তি এবং অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না ।’ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ আরব নেতা, তারপর বলল, মেজর আহসানের মৃত্যুতে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা বন্ধু ছিলাম ।’

উঠে দাড়াল সিক্স। দেয়ালে সার দেয়া বড় আকারের ফটোগাফ টাঙানো । কবি হাফিজ, রূমী, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল পাশাপাশি সাজানো। পুরো ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে আফ্রিকা-এশিয়ার কবি সাহিত্যিকদের ছবি। কর্ণেল সিক্স উঠে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির পিছন থেকে বের করে আনল একটা বাক্স। ম্যাজিশিয়ানদের মত টেবিলে রেখে বের করল তা থেকে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি অস্ত্র। উঠে দাড়াল রানা। সিক্স এগিয়ে ধরল দুটো পিস্তল। রানা তুলে নিল পয়েন্ট টু ফাইভ বেরেটা। চেক করে নিয়ে একটা ম্যাগাজিন ভরল। দুটো এক্সট্রা ম্যাগাজিন নিয়ে কোটের পকেটে রাখল। কর্নেল সিক্স এগিয়ে দিল কালো জার্মান-লেদারের শোল্ডার হোলস্টার।

তিন


ঠিক ন’টা পঁচিশ মিনিটে পৌছ্ল রানা হোয়াইট নাইল রেস্তোরায়। বিরাট রেস্তোরা, জাকজমকপূর্ণ। সামনে বিরাট চত্বর, গাড়ি পার্কি এর জায়গা, ফোয়ারার রঙীন বাতির বিচ্ছুরণ ইত্যাদি দেখে ক্লাব-ক্লাব মনে হয়। কাউন্টারে নিজের নাম বলে রানা গিয়ে বসল একটা ফাকা টেবিলে।

ঠিক ন’টা ত্রিশ মিনিটে, রানার সামনে ছিল ওল্ড গ্র্যান্ড ড্যাড বার্বনের বোতল । একটা পাত্রে বরফের টুকরো। টাম্বলার। গ্লাসে সিপ করতে করতে চারদিক দেখছে রানা । আবছা অন্ধকার ঘর। মৃদু বাজনা বাজছে, নীলের চেনা সুর।

এ বাজনা রানাকে মনে করিয়ে দেয় ক্রিওপেট্রার প্রমোদতরীর কথা?

হঠাৎ থমকে যায় রানার চোখ । হাতের গ্লাসটা টেবিলে নেমে আসে।

যে মেয়েটি এগিয়ে আসছে-তার পরনে শাড়ি । কালো শাড়ি, কালো ব্লাউস। রানা উঠে দাঁড়াল, নবাগতা টেবিলের কয়েক হাত দূরে থমকে দাঁড়াল। কালো চুল, কাঁধে লুটানো। কালোর পটভূমিতে এক অনিন্দ্য-সুন্দর মুখশ্রী। থমকে দাড়িয়েছে জিসান বাট। হ্যা, বলতে হলো না, এ-ই জিসান বাট। কালো দুটো চোখ রানাকে দেখল, আরও একটু উচু করল মুখ। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া একটি মুখ।

চেয়ারটা টেনে দিল রানা । এবার এগিয়ে এল জিসান বাট । একটু হাসি ফুটে উঠল গোলাপী ঠোটে । বলল, “মাসুদ রানা?’

রানাও হাসল, “জিসান বাট?

জিসান বসলে রানাও বসল ।

রানা কথা বলল না কয়েকটা মুহুর্ত। তারপর বলল, নীল নদের তীরে শাড়ি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি বাঙালি?

“না । তবে বাঙালী রক্ত আমার মধ্যে আছে। আমার দাদা মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন, মৃদুকন্ঠে জিসান বলল। “এখন আমরা পুরো মিশরীয় । শাড়ি শখ করে পরি।’ আবার থেমে আরও নিচু গলায় স্বগতোক্তির মত করে মেয়েটি বলল, “আহসান আমাকে ঢাকা থেকে অনেকগুলো শাড়ি এনে দিয়েছিল।

“আপনাদের আলাপ হয় কিভাবে?’

‘এখানে বাঙালী এলে কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। কারণ আমার পরিচয় এখানে বাঙালী ডাক্তার বলেই, জিসান বলল। “যদিও কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়।

রানা ভাবল, চোখে নীলের গভীরতা শুধু বাঙালী কেন, গ্রীনল্যান্ডের পুরুষদেরও মোহিত করতে পারবে । পৃথিবীর গভীরতম নদী, এই নীল নদ। নীল নদ মিশরের প্রাণ। কিন্তু গভীর চোখে এর উচ্ছাস নেই, আছে স্তব্ধতা, এবং আশ্চর্য এক ধরনের বক্রতা । হ্যা, বক্রতা । ওয়েটারকে খাবার আনতে বলল। মেয়েটি তার পছন্দের কথা বলল না। রানার হুকুমের বহর দেখে মুচকে হাসল শুধু হ্যাঁ, বাঁ না- কিছু বোঝা গেল না। রানা ড্রিঙ্কসের কথা বললে, গ্র্যান্ড ওন্ড ড্যাড বোতলের দিকে তাকিয়ে বলল, হুইস্কি…” চোখ আস্তে করে রাখল ড্যান্স ফ্লোরে। দু’একটা কাপল এগিয়ে গেল। মিশরীয় কি ইউরোপীয় চেনা যায় না। বাজনার সুরটা এখন ইউরোপীয় হয়ে গেছে।

ট্রে থেকে গ্লাসে বার্বন নিয়ে বেশ হালকা করে দিল রানা পানি মিশিয়ে। দু’টুকটো বরফ দিয়ে এগিয়ে দিল জিসানের সামনে। মেয়েটা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। গ্লাস নিল। এক চুমুক দিয়ে ধন্যবাদ জানাল। তারপর জিজ্ঞেস করল রানা সম্পর্কে। রানা উত্তর দিল গ্লাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে, মেয়েটির প্রতিটি ভঙ্গি দেখতে দেখতে ।

খাবার এলে আলোচনাটা খাবার কেন্দ্র করে হলো । মেয়েটি মিশরীয় খাবার…

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top