চাই ঐশ্বর্য – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Chai Oishwarjo – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

অক্টোবর ১৯৮৯। কেপ কেনেডি, ফ্লোরিডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
শোয়া নয়, আবার ঠিক বসাও বলে না একে। যদিও বসবার উপযোগী গদিমোড়া একটা আসনেই রয়েছে এয়ারফোর্সের ক্যাপ্টেন ভেভিভ মারফি, কিন্তু তার শরীরের পুরো ভর পড়েছে পিঠের উপর। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় উল্টে
পড়লে যা হয়, ঠিক সেভাবে আসলে উর্দ্ধমুখী হয়ে আছে সে ও তার তিন ক্রু। অস্বস্তিকর একটা অবস্থা; সঙ্গে যে সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ড ওজনের অতি-দাহ্য জ্বালানি আছে… সে চিন্তাও দূর করতে পারছে না মাথা থেকে। বিরক্তি নিয়ে শুনছে ও লঞ্চ ভিরেক্টরের রোবট-সুলভ কথাবার্তা — আবেগের বিন্দুমাত্র ছোয়া নেই তাতে। এয়ার-কন্ডিশনড রুমে বসে আরাম করছে ব্যাটা, অথচ কথা বলছে মরা মানুষের মত। সমস্যাটা কী! জীবনের প্রথম মহাকাশ-যাত্রার মাত্র কয়েক মিনিট বাকি; তারপরও উত্তেজনা অনুভব করছেনা মারফি, বরং বিরক্তিটাই ছেঁকে ধরছে ওকে। ইচ্ছে হলো রেডিও-লিঙ্কের ভিতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েক মাইল দূরে বসে থাকা লঞ্চ-ডিরেক্টরের টুঁটি চেপে ধরে । তা হলে মন্দ হতো না কিন্ত! মোটকা ডিরেক্টরের চমকে ওঠা চেহারাটা ভেসে উঠল মানসপটে, মৃদু কৌতুক অনুভব করল ও-হেলমেটের ফেস-শিল্ডের ওপাশে হাসি হাসি হয়ে উঠল মুখটা।
ইয়ারপিসে আবার শোনা গেল লঞ্চ ডিরেক্টরের কণ্ঠ । ‘আটলান্টিস, দিস ইজ কন্ট্রোল। এইচ-টু ট্রাঙ্কের প্রেশারাইজেশন ঠিক আছে। ইউ আর গোঁ ফর লঞ্ছ। ওভার।

রজার গ্রাউন্ড। উই আর গো ফর লঞ্চ। প্রত্যুত্তর দিল মারফি।

সময় গড়াতে শুরু করল, একঘেয়ে কথোপকথন চলল গ্রাউন্ড কন্ট্রোল আর মারফির ভিতর । আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিভিন্ন পয়েন্টের উপর প্রি-লঞ্চ চেক চলছে, দু’পক্ষই নির্বিকার । একটু পরেই উৎক্ষেপণ, অথচ কারও গলা শুনে সেটা বোঝার উপায় নেই। বাইরে, মহাকাশযানটার ককপিটের তাপনিরোধী জনালাগুলোর ওপাশে জমে বসেছে রাত- পুর্ব ফ্লোরিডাকে ঢেকে রেখেছে নিকষ আধার । আকাশের গায়ে মিট মিট করছে অগণিত তারা… সেগুলোর দিকে উড়াল দেবে ওরা খানিক পরেই।
অস্থির বোধ করল ক্যাপ্টেন, দেরি সহ্য হচ্ছে না আর। দূর আকাশের তারাগুলো হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে ওকে।
“আটলান্টিস, নিয়ন্ত্রণ এখন অনবোর্ড কম্পিউটারে ।
রজার ‘ বলে সায় জানাল মারফি।
ধীরে ধীরে কাউন্ট ডাউনের শেষ অংশে পৌছুল ঘড়ির কাঁটা। এতক্ষণে উত্তেজনা অনুভ্ভ করতে শুরু করল মারফি ।অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিটের গুঞ্জন, কিংবা চলতে থাকা বিভিন্ন ফ্যান আর মোটরের আওয়াজ আর শুনতে পেল না… কেমন যেন একটা ঘোর লাগল ওর–মনে হলো নিস্তব্দতা নেমে এসেছে ছোট্ট কেবিনটার ভিতর।

‘ফাইভ… ফোর… উই হ্যাভ মেইন ইঞ্জিন স্টাট..
সেকেন্ডের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে গর্জে উঠল অরবি্টার শাটলটার ইঞ্জিন, লাখ লাখ পাউণ্ড ওজনের প্রেশারের সাহায্যে একজস্ট দিয়ে বের করল আগুনের শিখা–সেটা এতই উত্তপ্ত যে, রঙটা একেবারে দুধ-সাদা। লঞ্চ প্লাটফর্মের ধাতব মেঝেতে বসাল নির্মম কামড় । তবে এই বিপুল অগ্নি-নির্গমনের খুব বড় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না মহাকাশযানটাতে–মাউন্টের উপর একটু শুধু উচু হলো ওটা, এই যা। নভোচারীরা একে টোয়াং বলে।

পাইলটের সিটে বসা ক্যাপ্টেন মারফি অবশ্য অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন ফুয়েলের এই নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ দেখতে পেল না; শুধুমাত্র শব্দতরঙ্গের ফলে সৃষ্ট ঝাঁকি অনুভব করল। এক মুহুর্তের জন্য দ্বিধা ভর করে উঠল ওর ভিতরে- সব ঠিকঠাক আছে তো?

গ্রাউণ্ড কন্ট্রোল ওদিকে কাউন্টডাউন করে চলেছে। “থ্রি. টু… ওয়ান…” মহাকাশযানটাকে আটকে রাখা ক্লাম্পগুলো সরে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল নিরেট রকেট বুস্টারগুলো। প্রতিটা বুস্টার আটলাস্টিসের ইন্টারনাল মোটরের চাইতে দ্বিগুণ শক্তি খরচ করছে। ককাপিটে ব্সা মারফি ও তার তিন ক্রু পিঠে প্রবল চাপটা অনুভব কর… তীব্র বেগে উঠতে শুরু করেছে গোটা মহাকাশযানের কাঠামোটা।

বুস্টার ইগনিশনের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার গ্যালন পানির প্রবাহ ঘটিয়ে দেয়া হয়েছে একজস্ট নজল-গুলোর নীচে, তীব্র উত্তাপে বাষ্পে পরিণত হলো তা- সাদা একটা মেঘে ঢেকে গেল বেরিয়ে আসা আগুনের ধারা ।

উই হ্যাভ লিফট্-অফ! ঘোষণা করা হলো গ্রাউণ্ড কন্ট্রোল থেকে। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে টাওয়ারকে পেরিয়ে গেল শাটল, আলোকিত করে তুলল চতুর্দিক–সূর্যোদয়ের বহু আগেই যেন ফ্লোরিডা মানগ্রোভ গাছে ভরা জলাভূমিকে নীচে ফেলে উপরে উঠে চলন ওটা, পিছনে রেখে যাচ্ছে প্লাজমা ট্রেইল… ওটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রাতের আকাশটার মাঝে ছুরি চালিয়েছে কেউ–দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে।

খুব দ্রুত গতি বেড়ে চলল মহাকাশযানের– চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে সাউন্ডব্যারিয়ার অতিক্রম করল, শব্দের চেয়ে দ্রুতবেগে চলছে ওটা এখন, প্রতি মুহুর্তে দ্রুততর হচ্ছে। দু’মিনিটের ভিতর রকেট বুস্টারগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে গেল, তবে ততক্ষণে ভূপৃষ্ট থেকে আটাশ মাইল উপরে পৌছে গেছে আটলান্টিস, ছুটছে শব্দের গতির চেয়ে সাড়ে চার গুণ জোরে।

মাধ্যাকর্ষণের টান স্বাভাবিকের চাইতে তিন গুণ গেছে ইতোমধ্যে; আরো বাড়তে পারত, কিন্তু অনবোর্ড কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাটলের মেইন ইঞ্জিনে ফুয়েলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় সেটা ঘটছে না। মারফির মনে হলো
খদিমোড়া সি্টটার উপর তাকে ঠেসে ধরে রেখেছে কোনও আসুরিক শক্তি ।

অবস্থাটা সহ্য করবার জন্য ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে তাকে, নতুন কিছু নয় ব্যাপারটা… তারপরও অনুভূতিটা বিস্ময়কর। হাতল থেকে হাত তোলার মত সামান্য কাজটাও এখন পরিণত হয়েছে অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ; ওটুকু করতে শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগাতে হচ্ছে–এমনই প্রবল মাধ্যাকর্ষণের টান।

‘আটলান্টিস, উই হ্যাভ এসআরবি সেপারেশন ।’

রজার বলল মারফি চমৎকার দৃশ্য।

আসলেই তা-ই । জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, শাটলের এক্সটারনাল ট্যাঙ্কের শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে জ্বালানি-ফুরোনো বুস্টারদুটো; পাক খেয়ে নীচ দিকে নামছে… বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে জ্বলছে চোখ-ধাধানো আতশবাজির মত । ওটাকে পিছনে ফেলে উপরে উঠে চলল অরবিটার-শাটল, আগের চেয়েও দ্রুতবেগে।

ভূপৃষ্ঠ থেকে বাষট্টি মাইল উচ্চতায় পৌছুতেই দিগন্তে উদয় হলো সূর্য। চার নভোচারী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে, আর এই ফাঁকে আটলান্টিস পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফিয়ার ভেদ করে পৌছে গেল মহাশুন্যে । এ এক অদ্ভুত জগত– সুন্দর, সুনীল গ্রহটা এখানে স্রেফ একটা রঙচঙা গোলক… শূন্যতার মাঝে ভাসছে নিঃসঙ্গভাবে।

‘আটলানিস দিস ইজ গ্রাউন্ড। ইউ নেগেটিভ রিটার্ন। ডু ইউ কপি?’

নেগেটিভ রিটার্নের মানে হলো মহাকাশযানটা এমন একটা উচ্চতা ও দূরত্বে পৌছে গেছে, যেখান থেকে উত্ক্ষেপণটা আর বাতিল করা সম্ভব নয় । ভালমন্দ যা-ই ঘটুক, উত্ক্ষেপণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ওদেরকে এখন শেষ করতেই হবে।

‘রজার, গ্রাউন্ড,’ হিউস্টন কন্ট্রোলকে জবাব দিল মারফি- ওরা এখন কেপ কেনেডির কাছ থেকে মিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। মার্কিন স্পেস-প্রোগ্রামের এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ-কেন্দ্রটার অবস্থান টেক্সাসে ।

আট মিনিট পর মেইন-ইঞ্জিনে একটা গররগর শন্দ উঠল-একটারনাল ট্যাঙ্ক থেকে ফুয়েলের শেষ বিন্দুটটাও খরচ হয়ে গেছে। থেমে গেল ইঞ্জিন্টা, একই সাথে শাটলের ভিতরে নেমে এল পিনপতন নীরবতা । হঠাৎ শরীরটা খুব হালকা মনে হলো মারফির কাছে, মুক্ত দুটো হাত সিটের হাতল থেকে উঠে গিয়ে পেজা তুলোর মত ভাসতে শুরু করেছে– পৃথিবীর আকর্ষণ পেরিয়ে এসেছে ওরা। মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল তার–এমন একটা জিনিস অর্জন করতে পেরেছে, যা বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না– স্বপ্নপূরণ ।

আটলান্টিস, গোর ফর ই.টি. সেপারেশন!

রজার এক্সটারনাল ট্যাঙ্ক সেপারেশন… নাউ!

বিদ্যুত্চমকের মত ছোট ছোট কয়েকটা বিক্ষোরণ ঘটিয়ে আলগা হয়ে গেল সংযোগ– অরবিটারের ছোট শরীর, থেকে খসে পড়ল অবিশ্বাস্য আকৃতির ট্যাংটা, ঘুরপাক খেতে খেতে চলে যাচ্ছে আটমোস্ফিয়ারের দিকে । মাটিতে পড়বার আগেই বায়ুমন্ডলের ঘর্ষণে ছাই হয়ে যাবে।

মারফির পিছনে বসে আছে শাটলের পে-লোড সায়েন্টিস্ট এডমন্ড জারেট। মুচকি হেসে সে বলল, ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তিটা পদার্থবিদ্যার একটা চিরাচরিত নিয়ম হতে পারে, তবে নিউটনিয়ান মেকানিকসও কম যায় না-নিয়মকে বুড়ো আঙুল
দেখানোয় ওস্তাদ ।’

ওর বলার ভঙ্গিতে হাসি ফুটল সবার মুখে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিটা সহজ হয়ে এল মুহুর্তে।

অরবিটে পৌছে গেল আটলান্টিস। দু’ঘণ্টা পর খুলে দেওয়া হলো পে-লোড বে’র দরজা- বাড়তি তাপ বেরিয়ে যাবার জন্য। ক্রু’রা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাদের প্রাইমারি মিশন টাস্ক নিয়ে। ইতোমধ্যে জিরো-গ্রাভিটির বিরুপ প্রতিক্রিয়া
পড়তে শুরু করেছে তাদের উপর, আগামীকাল নাগাদ আর স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারবে না। এ-কারণে নাসা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শাটলটা পৃথিবীর আড়াইশ মাইল উপরের অরবিটে স্টেবল হবার পর যত দ্রুত সম্ভব পে-লোড লঞ্চ করা হবে।

উত্তেজনা বোধ করছে মারফি এবং ওর অপর তিন সঙ্গী, শরীরে অ্যাড্রেনালিনের নিঃসরণ ঘটছে। সেটা বেশিরভাগ শারীরিক সমস্যাকে চাপা দিতে পারলেও বমি বমি ভাবটাকে দূর করতে পারেনি। এটাই ওদেরকে ধীরে ধীরে অচল করে ফেলবে। নাসার কনভার্টেড বোয়িঙে চড়িয়ে চড়িয়ে জিরো-গ্র্যাভিটির এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে শেখানো হয়েছে ওদেরকে, তারপরও কৃত্রিম পরিবেশ আর সত্যিকার পরিবেশের মাঝে তফাত্টা যে কত বড় হতে পারে, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নভোচারীরা । পাইলটের চেয়ারে বসে মারফি ভাবছে, সবার আগে বমিটা যেন তাঁকে করতে না হয়।

‘আটলান্টিস, দিস ইজ গ্রাউন্ড। পে-লোড ডেপ্লয়মেন্টের জন্য এখন তোমাদেরকে ড্যানিডেনবার্গের আন্ডারে ট্রান্সফার করা হচ্ছে । একটা স্যাটেলাইট রয়েছে শাটলের কার্গো-বে’তে; আগেই ঠিক করা হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার ড্যানিডেনবার্গ এয়ারফোর্স বেস সেটার ডেপ্লয়মেন্ট তদারক করবে। । এই বিশেষ জিনিসটাকে, অরবিটে স্থাপন করবার জন্যই আসলে পাঠানো হয়েছে আটলান্টিসকে; যদিও নাসার অফিসিয়াল প্রেস রিলিজে এটাকে সায়েন্টিফিক ভেঞ্চার বলে বর্ণ্না করা হয়েছে।


“রজার, ভ্যানডেনবার্গ। সবুজ সঙ্কেত রিসিভ করছি । আঠারো মিনিটের মধ্যে ডেপ্লয়মেন্ট হবে? সময়টা খুবই অল্প– ডেপ্লয়মেণ্টটা যাতে ডিটেক্ট হয়ে না যায়, সেজন্য ইচ্ছে করেই খুব তাড়াতাড়ি সারা হবে কাজ। ইন্টারনাল রেডিও অন্‌ করল মারফি। সঙ্গী বিজ্ঞানীকে বলল, ‘এডমণ্ড, আঠারো মিনিট তোমার হাতে । কাজ কেমন এগুচ্ছে? রওনা হবার আগে নাশতা খেয়েছিলাম, স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে বলল জ্যারেট। “ওটা গলা দিয়ে নামার সময় যতটা ভাল লেগেছিল, উঠে আসার সময় ততটাই খারাপ লাগছে। তবে চিন্তা করো না, টাইমটেবল মেইনটেইন করতে পারব।

শাটলের আফট ক্রু-স্টেশনের সামনে বসে আছে সে আর ওয়াল্টার ফ্লেমিং — পে-লোডের অপর বিশেষজ্ঞ। পুরো মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে। স্যাটেলাইটটা নিরাপদে কার্গো বে থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওরাই এখানকার হর্তা-কর্তা-বিধাতা’ । রোটেশনাল কন্ট্রোলার নিয়ে কাজ করছে ফ্লেমিং- ওটা, আটলান্টিসের রোল, পিচ, ইঅ ইত্যাদিকে সামাল দেয়। জ্যারেটের এক্সপার্টিজ শাটলের ম্যানিপুলেটর আর্মকে নিয়ে। শাটল আর
স্যাটেলাইটের কাঠামো, সেই সঙ্গে মাইক্রোগ্রাভিটির বিরুপ প্রভাবের কারণে ওদের দুজনের কাজটাই সবচেয়ে কঠিন ও সূক্ষ্ম। ভুল-ক্রুটির কোনও অবকাশ নেই, কারণ ওরা শুনেছে-মেডিউসা নামের যে-গোপন স্যাটেলাইটটাকে ওরা স্থাপন করতে চলেছে, সেটা তৈরি করতে ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে । কথাটা সত্যি কি মিথ্যে কে জানে! তবে বাস্তবতা হলো মহামূল্যবান বস্তুটার ভালমন্দের সমস্ত দায়িত্ব এখন ওদের দু’জনের হাতে ।

সাবধানে কাজ করো, এডমণ্ড, সকৌতুকে বলল ফ্লেমিং। ‘ঘাপলা করলে কিন্তু সারাজীবনে আর কখনও সরকার তোমার টাক্স রিফান্ড করবে না।’ জয়স্টিক নেড়ে স্টোরেজ র‍্যাক থেকে ম্যানিপুলেটর আর্মটা বের করায় ব্যস্ত
জ্যারেট। ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘হ্যা, এমনিতে তো রিফাণ্ড করে কৃতার্থ বানিয়ে রেখেছে আর কী!

‘আটলান্টিস, দিস ইজ ভ্যানডেলবার্গ। গ্রাউন্ড ট্রাকিং বলছে তোমরা পজিশনের কাছাকাছি রয়েছ । পে-লোড রিলিজ ইন ইলেভেন মিনিটস।’ .

‘রজার দ্যাট, গ্রাউন্ড। ইলেভেন মিনিটস্‌।’ জবাব দিল, জ্যারেট। বমি ঠেকাবার জন্য ঢোক গিলল বড় করে ।

“খারাপ লাগছে? জানতে চাইল ফ্লেমিং।

উহ” মাথা নাড়ল জ্যারেট, ঢেকুর তুলল একটা । “আমাদের অ্যাটিচিউড কেমন?

‘অন দ্য মার্ক… নববুই ডিগ্রি কোণে নাক নামিয়ে রেখেছি। এভরিথিং ইজ পারফেক্ট ।

‘তারপরও ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না আমার,” অস্বস্তি নিয়ে বলল জ্যারেট। “অরিজিনাল মিশন প্লানে আমাদের পুরো একটা দিনের সিস্টেমস্‌ চেক, আর ম্যানিপুলেটর আর্ম নিয়ে প্র্যাকটিস করবার কথা ছিল।

‘ওই প্লানে আমাদের গতকালকে লঞ্চ করবার কথা ছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন? দোষ দিতে হয়, প্রকৃতি-মাতাকে দাও । ঝড়-টা আমাদের কেউ ডেকে আনেনি ।’ কাধ ঝাকাল ফ্লেমিং। ‘তা ছড়া… স্যাটেলাইটটা যত কম সময় আমাদের সঙ্গে থাকে, ততই ভাল। ঘাড়ের উপর এমন, একটা বোঝা চেপে থাকলে ভাল লাগে না । শুনেছ তো, ওটা কী করতে পারে…

‘বক বক থামিয়ে কাজ করো, বাছারা বিরক্ত একটা কন্ঠ ভেসে এল সামনে থেকে । কর্নেল মাইক ডোনোভানের কন্ঠ ওটা–শাটল কমান্ডার । ফ্লাইটের সার্বিক দায়িত্ব তার কাঁধে। শাটলের বাকি তিন ক্রু’র মত অনভিজ্ঞ নন কর্নেল, আগেও মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি ও এয়ারফোর্সের যৌথ উদ্যোগে করা একটা গোপন মিশনে ছ’মাস আগেই একবার এসেছিলেন তিনি।

চুপ হয়ে গেল দুই বিশেষজ্ঞ। পালা করে সামনের ভিডিও মনিটর আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে ম্যানিপুলেটর আর্মটা অপারেট করল জ্যারেট, মেডিউসা স্যাটেলাইটের প্র্যাপেলের সঙ্গে আটকাল ওটা । নিকষ কালো মহাশৃন্যের মাঝখানে স্যাটেলাইটের ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইযারটাকে স্রেফ একটা চিকন সাদা রেখার মত দেখাচ্ছে।

‘চার মিনিট, জ্যারেট ঘোষণা করলেন ডোনোভান।

‘রজার, বলল জ্যারেট। ম্যানিপুলেটর আর্মের এলবো-ক্যামেরা থেকে পাওয়া ভিডিও-ফিডে সেটে রয়েছে তার চোখ। ওতে ষাট-ফুট দৈর্ঘ্যের কার্গো -বে’র ভিতরে মেডিউসাকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে৷ ডেপ্লয় হবার আগ পর্যন্ত সোলার প্যানেল আর ট্রানসিভার ডিশ ভাজ হয়ে রয়েছে স্যাটেলাইটের গায়ে; ওটাকে দেখাচ্ছে বিশাল, কালো রঙের একটা চোঙার মত। কার্গো -বে’র সবক’টা ফ্লাডলাইট জ্বলবার পরও ঘন কৃষ্ণবর্ণটা একবিন্দু হালকা – ওটার রেইডার অ্যাবজর্বিং চামড়া যেন আর্লোকেও শুষে নিচ্ছে, ঠিক একটা ব্যাকহোলের মত। দৃশ্যমান একমাত্র সেন্সরটা যেন কামানের মুখ, ওটার ভিতরে জট পাকিয়ে রয়েছে সোনালি রঙের নানা রকম ওয়্যায়ার।

শল্যচিকিৎসকের দক্ষতায় ম্যানিপুলেটর আর্মের জয়স্টিক নাড়ল জ্যারেট, মেডিউসাকে তুলে আনল কার্গো-বে’র খাজ থেকে। ভূপৃষ্ঠে আর্মটার শক্তি একজন সাধারণ মানুষের বাহুর চাইতে কম, তবে মহাশূন্যে ওটা অনায়াসে এগারো-টন ওজনের স্যাটেলাইটটাকে নড়াতে পারে। বিশাল এক পতঙ্গের বাহুর মত দেখাল ওটাকে, বে’র মেঝের উপর ঝুলিয়ে রেখেছ মেডিউসাকে ।

গুড়ুত-গাড়ুত করতে থাকা পাকস্থলীকে সামাল দিতে দম আটকাল জ্যারেট-জয়স্টিক সামান্য নড়লে স্যাটেলাইটটা বাড়ি খেতে পারে শাটলের দেয়ালে, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে । তাড়াতাড়ি আর্মটাকে বোতাম চেপে লক করল ও, তারপর একটা মোশন-সিকনেস ব্যাগ বের করে তার মধ্যে হড়হড় করে বমি করে দিল।

‘আই অ্যাম টেকিং ওভার দ্য লঞ্চ, বলে উঠল ফ্লেমিং। সঙ্গীকে বাচাল আসলে ।

ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল জ্যারেট, বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানাল-চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সিট ছেড়ে উঠে পড়ল সে।

কর্ণেল ডোনোভানও উঠল, ভেসে চলে এল ম্যানিপুলেটর আর্ম কন্ট্রোলের পিছনে বসানো ওঅর্ক- প্লাটফর্মে। রেডিওতে বলল, “ভ্যানডেনবার্ কন্ট্রোল, দিস ইজ আটলান্টিস। পে-লোড সেপারেশনের জন্য তৈরি আমরা । আটিচিউড ম্যাচ
কনফার্মড ।

স্বস্তি বোধ করল ফ্লেমিং, কর্নেল নিজে নেয়ায় ভাল হলো। এ-ধরণের কাজে মাথা উপর ছায়া থাকলে ভাল লাগে।

রেডিওতে এবার নতুন একটা কন্ঠ শোনা গেল। ‘আটলান্টিস দিস ইজ জেনারেল ফ্রাঙ্কলিন। কে ওখানে… মাইক নাকি?

ইয়েস, স্যার। কাউন্টডাউনের জন্য তৈরি আমরা। ছুটিটা শুরু করবার জন্যও।

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top