চাই সাম্রাজ্য – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Chai Samrajya – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

পনেরোই জুলাই, তিনশো একানব্বুই খিস্টাব্দ।

নিবিড় কালো সুড়ঙ্গপথে ছোট্ট, কাপা কাপা একটা আলো ভূতুড়ে আবহ তৈরি কর়েছে। লোকটার পরনে আটো জামা, উল দিয়ে বোনা, নেমে এসেছে হাটু পর্যস্ত । থামলো সে, হাতের কুপিটা মাথার ওপর উচু করে ধরলো । ছোট্র শিখার আভায় আলোকিত হয়ে উঠলো মানুষের একটা দেহ, স্বর্ণ আর স্ফটিকের তৈরি একটা বাক্সের ভেতর রয়েছে ওটা। পিছনের মসৃণ দেয়ালে নৃত্য করছে কিম্বুতকিমাকার ছায়াগুলো । আটো জামা পরা জুনিয়াস ভেনাটর দৃষ্টিহীন চোখজোড়ার দিকে কয়েক মুহুর্ত নীরবে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর কুপি নামিয়ে আরেক দিকে ঘুরলেন।

দীর্ঘ এক সারিতে দাড়িয়ে রয়েছে নিশ্চল মুর্তিগুলো যেন মৃত্যুপুরীর নিস্তব্দতার ভেতর ; সংখ্যায় এতো বেশি যে গুণে শেষ করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ ।

হাটতে শুরু করলেন জুনিয়াস ভেনাটর, অমন মেঝেতে তার পায়ের ফিতে বাধা স্যাণ্ডেল খসখস আওয়াজ তুললো ৷ ক্রমশ চওড়া হয়ে বিশাল এক গালারিতে মিশেছে সুরঙ্গপথট৷ | গম্বুজ আকৃতির সিলিংটাকে অবলম্বন দেয়ার জন্যে খিলান তৈরি করায় প্রায় ত্রিশ ফুট উচু গ্যালারি কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে । খানিক পর পর দেয়ালের চুনাপাথর কেটে একটা করে লম্বা ও গভীর দাগ টানা হয়েছে, ওগুলো দিয়ে ছাদের পানি নেমে এসে মেঝের চওড়া নর্দমায় পড়ে । দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন আকৃতির গর্ত; প্রতিটিতে অদ্ভুতদর্শন, গোলাকৃতি পাত্র, ব্রোঞ্জের তৈরি । খোদাই করা বিশাল এই গুহার মাঝখানে একই আকৃতির বড় ঝড় কাঠের বাক্সগুলো না থাকলে ভীতিকর জায়গাটাকে রোমের নিচে পাতাল সমাধিক্ষেত্র বলে ভূল হতে পারতো ।

শেষ প্রান্তে তামার পাতে মোড়া ফিতে রয়েছে প্রতিটি বাক্সের সাথে, পাতগুলোয় বাক্সের নম্বর লেখা । প্যাপিরাস খুলে কাছাকাছি একটা টেবিলে সমান করলেন ভেনাটর, তাতে লেখা নম্বর তামার পাতে লেখা নম্বরের সাথে মেলালেন। বাতাস শুকনো আর ভারি, ঘামের সাথে ধুলো মিশে কাদার মতো জমছে গায়ে । দু’ঘন্টা পর সন্তুষ্ট বোধ করলেন তিনি, প্রতিটি জিনিসের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্যাপিরাসটা গুটালেন, কোমরে জড়ানো কাপড়ের ভাজে ঢুকিয়ে রাখলেন সেটা।

ঘুরে ঘুরে গ্যালারির চারদিকে সাজানে৷ সংগ্রহগুলোর দিকে আরেকবার তাকালেন ভেনাটর, অতৃপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুকের ভেতর থেকে । জানেন, এ-সব আর কোনোদিন তার দেখা বা ছোঁয়ার সুযোগ হবে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুরলেন তিনি, হাতের কুপিটা বাড়িয়ে ধরে এগোলেন ফিরতি পথে।

বয়স হয়েছে ভেনাটরের, কিছুদিনের মধ্যে সাতষট্টিতে পড়বেন । মুখে অনেক ভাজ আর রেখা ফুটেছে, ক্লান্ত চরণে, আগের সেই ক্ষিপ্রতা নেই, বেঁচে থাকার আনন্দ এখন আর তিনি তেমন উপভোগ করেন না । তবে অনেক দিন পর আজ তার সত্যি ভারি আনন্দ হচ্ছে, তৃপ্তি আর সত্তৃষ্টির একটা অনুভূতি প্রাণশক্তির নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে তার শরীরে । বিশাল একটা কর্মসূচী সাফল্যের সাথে শেষ করেছেন তিনি । কাধ থেকে নেমে গেছে গুরুদায়িত্ব | বাকি আছে শুধু দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রোমে ফিরে যাওয়া । কে জানে কি আছে ভাগ্যে, সমুদ্রযাত্রাা নিরাপদ হবে কিনা তা শুধু নিয়তিই বলতে পারে।

আরো চারটে সুড়ঙ্গপথ ঘুরে পাহাড়ে বেরিয়ে এলেন ভেনাটর। ইতিমধ্যে একটা স্ড়ঙ্গপথ পাথর ধসে বন্ধ হয়ে গেছে। ছাদ ধসে পড়ায় ওখানে বারোজন ক্রীতদাস পাথর চাপা পড়ে মারা গেছে । এখনো সেখানেই আছে তারা, চিড়ে চ্যাপ্টা লাশগুলোর কবর হয়ে গেছে পাথরের তলায় । একট। দীর্ঘশ্বাস চাপলেন ভেনাটর। ওদের জন্যে দুঃখ করা অযৌক্তিক মনে হলো তার । এখান থেকে ফিরে আবার তো! সেই সম্রাটের খনিতেই কাজ করতে হতো ওদেরকে । আধপেটা খেয়ে,
রোগ-শোকে ভুগে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে এ বরং ভালোই হয়েছে । বেঁচে থাকাই ছিলো ওদের জন্যে অভিশাপ ।

সুড়ঙ্গ মুখটা এমনভাবে পাথর কেটে তৈরি যে বড় বাক্সগুলো ভেতরে ঢোকাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। পাহাড়ে বেরিয়ে আসছেন ভেনাটর, এই সময় দূর থেকে একটা রোমহর্ষক আতচিৎকার ভেসে এলো। কপালে উদ্বেগের রেখা নিয়ে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি, আলোয় বেরিয়ে এসে চোখ কৌচকালেন। থমকে দাড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে তাকালেন তিনি, ঢালু একটা প্রান্তর জুড়ে সেটার বিস্তৃতি । অসভ্য কয়েকটা যুবতী মেয়েকে ঘিরে দাড়িয়ে রয়েছে একদল রোমান সৈনিক । সম্পূর্ণ বিবস্ত্র একটা মেয়ে আবার চিৎকার করে উঠে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলো | সৈনিকদের পাচিল ভেঙে প্রায় বেরিয়ে এলো সে, কিন্ত সৈনিকদের একজন তার লম্বা কালো চুল ধরে হ্যাচকা টান
দিলো, ধুলোর ওপর ছিটকে পড়লে মেয়েটা ।

দৈত্যাকার এক লোক ভেনাটরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো । ক্যাম্পের সবার চেয়ে লম্বা সে, বিশাল কাধ, আর শক্তিশালী বাহু, হাতের শেষ প্রান্ত খুলে আছে হাটুর কাছাকাছি ।

গল জাতির লোক লাটিনিয়াস মাসার, ক্রীতদাসদের প্রধান ওভারশিয়ার সে। হাত নেডে অভ্যর্থনা জানালো ভেনাটরকে, কথা বললো অস্বাভাবিক তীক্ষ আর কর্কশ কন্ঠে। “সব দেখলেন ?

মাথা ঝাঁকালেন ভেনাটর | “হ্যা, তালিকা মেলানো হয়েছে। সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করতে পারো ।”

ধরে নিন বন্ধ হয়েছে।

ক্যাম্পে কিসের হৈ-চৈ ?

ঘাড় ফিরিয়ে সৈনিকদের দিকে একবার তাকালো মাসার, ঘন ভুরু জোড়ার ভেতর তার লাল চোখ দপ করে জ্বলে উঠলো যেন, একদলা থুথু ফেলে আবার তাকালে ভেনাটরের দিকে । তার কথা থেকে জান গেল, বোকা সৈনিকরা অস্থির হয়ে পড়েছিল, এখান থেকে পাঁচ লীগ উত্তরের একটা গ্রামে হামলা চালিয়ে এইমাত্র ফিরে এসেছে । এই
নির্মম রক্তপাতের কোনে মানে নেই । কম করেও চল্লিশজন অসভ্য মারা গেছে। তাদের মধ্যে পুরুষ ছিলো মাত্র দশজন, বাকি সবাই শিশু আর নারী । লাভ কিছুই হয়নি, কারণ সোনা আর অন্যান্য জিনিস যা সৈনিকরা লুট করে এনেছে তার মুল্য গাধার বিষ্ঠার সমানও নয় । আর এনেছে কুংসিতদশন কিছু মেয়েলোক ।

চেহারা কঠোর হয়ে উঠলো ভেনাটরের | ‘আর কেউ বেঁচে গেছে?

শুনলাম দু’জন পুরুষ নাকি জঙ্গলে পালিয়েছে ।

“তারা তাহলে অন্যান্য গ্রামে আওয়াজ দেবে । সবনাশ, সেভেরাস দেখছি মৌমাছির চাকে টিল ছু’ড়েছে !

‘সেভেরাস! ঘৃনায় কুচকে উঠলো মাসারের ঠোটের কোণ । “ওই ব্যাটা সেনটিউরিয়ান আর তার দল শুধু ঘুমোয় আর আমাদের মদ সাবাড় করে। পাছায় গরম লোহার ছ্যাকা দিন, তবে যদি ওদের কুঁড়েমি দুর হয় ।

“ওরা আমাদের রক্ষা করবে? সেজনোই ভাড়া করা হয়েছে” মনে করিয়ে দিলেন ভেনাটর।

“কার হাত থেকে রক্ষা করবে? ব্যঙ্গের স্বরে জিজ্ঞেস করলো। মাসার | ধর্মহীন বর্বরদের হাত থেকে, যারা পোকা আর সাপ-ব্যাঙ খায়?

“ক্রীতদাসদের এক জায়গায় জড়ো করো; তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দাও সুড়ঙ্গমুখ | খুব সাবধান, মাসার, কাজে যেন কোনো খুঁত না থাকে । আমরা চলে যাবার পর অসভ্যরা যেন আবার খুঁড়তে না পারে।

“সে ভয় করবেন না । যতোটুকু দেখলাম, এই অভিশপ্ত দেশে এমন কেউ নেই যে ধাতুবিদ্য। জানে। ” মুখ তুলে সুডঙগপথের মাথার ওপর তাকালো মাসার, গাছের বিশাল কাণ্ড পাশাপাশি সাজিয়ে প্রকাণ্ড মাচা তৈরি করা হয়েছে, মাচার ওপর পাথর, বালি আর মাটির আকাশছোয়া স্তূপ। স্তূপটা হেলান দিয়ে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। ‘মাচাটা সরিয়ে নেয়ার পর গোটা পাহাড় ধসে পড়বে, তখন যদি পাঁচশো হাতি থাকে নিচে, একটাকেও খুজে পাওয়া যাবে না । আপ- নার মহামূল্য শিল্পকর্ম চিরকাল অক্ষতই থাকবে, ভেনাটর।

নতুন করে আশ্বস্ত বোধ করলেন ভেনাটর | ওভারশিয়ারকে বিদায় করে দিয়ে রাগের সাথে ঘুরে দাড়ালেন, সেভেরাসের তাবুর দিকে যাচ্ছেন ।

সামরিক বাহিনীর একটা প্রতীক চিহ্নকে পাশ কাটালেন ভেনাটর, বর্শার মাথায় একটা রূপালী ঘাড় । একজন প্রহরী বাধা দিতে এগিয়ে এলো, এক ধাক্কায় তাঁকে সরিয়ে দিয়ে তাবুর ভেতর ঢুকলেন তিনি । তাবুর ভেতর একটা ক্যাম্প-চেয়ারে বসে রয়েছে সেনটিউরিয়ান, কোলের ওপর নগ্র অসভ্য নারী। জীবনে বোধহয় কখনো গোসল করেনি মেয়েটা । সেভেরাসের দিকে মুখ তুলে দুর্বোধ্য কিচিরমিচির শব্দ করছে সে। বয়স নেহাতই কম, পনেরোর বেশি হবে না । সেভেরাসের গায়ে শুধু বুক ঢাকা আটো জামা। তার নগ্ন বাহু একজোড়া ব্রোঞ্জের তৈরি রন্ধনী দিয়ে অলংকৃত, দুই বাইসেপ কামড়ে আছে । একজন বীর যোদ্ধার পেশীবহুল বাহু, ঢাল আর তলোয়ার ধরায় যার রয়েছে দীর্ঘ কালের অভিজ্ঞতা ।

ভেনাটরের আকম্মিক আগমনে মুখ ফিরিয়ে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করলো ন৷ সেভেরাস।

“তাহলে এভাবেই তোমার সময় কাটছে, সেভেরাস ? তিরস্কার করলেন ভেনাটর, তার কন্ঠে শীতল ব্যঙ্গ । “বিধর্মী একটা মেয়েকে নষ্ট করে ঈশ্বরের ক্রোধ অর্জন করছো ?

কঠিন কালো চোখ ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ভেনাটরের দিকে তাকালো সেভেরাস। “দিনটা আজ এতো! গরম যে আপনার খৃস্টীয় প্রলাপ শোনার ধৈর্য হবে না। আমার ঈশ্বর আপনার ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীল ।”

“সত্যি, কিন্তু তুমি মুর্তি পুজো করো ।

“যাকে যার খুশি পূজা করতে পারে, প্রশ্নটা একান্তই বাছাইয়ের । আপনি বা আমি, কেউই আমরা নিজেদের ঈশ্বরকে মুখোমুখি কখনো দেখিনি । কে বলবে কারটা/খাটি ?
‘যীশু হলেন প্রকৃত ঈশ্বরের সন্তান।’
হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলালো সেভেরাস । “আপনি আমার ব্যক্তিগত সময় দখল করেছেন ! সমস্যা কি, বলে বিদায় হোন ।”
“তুমি যাতে বেচারি মেয়েটাকে নষ্ট করতে পারো ?
জবাব না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো সেভেরাস। বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটাকে বস্তার মতো বিছানার ওপর ছু’ড়ে দিলো সে। ‘আমার সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছে আছে আপনার, ভেনাটর ? থাকলে বলুন, আপনাকে প্রথম সুযোগ দেবো ।
সেনটিউরিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ভেনাটর। ভয়ের একটা ঠাণ্ডা শ্রোত-বয়ে গেল তার শরীরে | যে রোমান সেনটিউরিয়ান একটা পদাতিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয় তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে, কিন্ত
এ-লোক নির্দয় পশু | “এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে” বললেন ভেনাটর । ‘ক্রীতদাসদের নিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দিচ্ছে মাসার । তাবু গুটিয়ে জাহাজে উঠতে পারি আমরা ।’
“ঈজিপ্ট ছেড়েছি আজ এগারো মাস । আনন্দ-ফুতির জন্যে আরেকটা দিন দেরি করলে কোনে ক্ষতি নেই।”
“আমরা লুটপাট করতে আসিনি । অসভ্যরা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। আমরা মাত্র ক’জন, তারা অনেক।’
“আমাদের বিরুদ্ধে যতো অসভ্যই পাঠানো হোক, আমার সৈনিকর। তাদের সামলাতে পারবে ।
“তোমার লোকজন দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

“রণকৌশল তারা ভূলে যায়নি,” আত্মবিশ্বাসের হাসি নিয়ে বললো সেভেরাস ।

“কিন্ত তারা কি রোমের মর্যাদা রক্ষার জন্যে আত্মত্যাগ করবে ?”

কোন্‌ দুঃখে, কেন? সাম্রাজ্যের সুদিন এসে আবার চলে গেছে। আমাদের এককালের তিলোত্তমা টাইবার আজ নোংরা বস্তিতে পরিণত হয়েছে । আমাদের শিরায় যদি রোমান রক্ত থেকেও থাকে, তা খুবই কম। আমার বেশির ভাগ লোকজন প্রদেশগুলোর আদি বাসিন্দা । আমি একজন স্প্যানিয়ার্ড আর আপনি একজন গ্রীক, জুনিয়াস ভেনাটর। আজকের এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে এমন একজন সম্রাটের প্রতি আধপোয়া বিশ্বস্ততাও থাকবে কেন, যে সম্রাট বহুদুর পুবের একটা শহর থেকে শাসন করেন ? এমনকি শহরটাকে আমরা কেউ দেখিনি পর্যন্ত । না, জুনিয়াস ভেনাটর, না- আমার সৈনিকরা যুদ্ধ করবে, কারণ তারা পেশাদার যোদ্ধা, কারণ তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্যে ভাড়া
করা হয়েছে ।

“কিংবা অসভ্যরা তাদেরকে বাধ্য করবে ।”

‘যখনকার সমস্যা তখন । সত্যি যদি অসভ্যদের দূর্মতি হয়।”

“সংঘর্ষ এড়ানো গেলে সব দিক থেকে ভালো । আমি সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই রওনা হতে চাই– ।,

বিকট শব্দে বাধা পেলেন ভেনাটর, পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠলো মাটি । এক ছুটে তাবু থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে তাকালেন তিনি । মাচার নিচ থেকে অবলম্বনগুলো সরিয়ে নিয়েছে ক্রীতদাসরা, বিশাল আকারের কয়েকশ টন পাথরসহ মাটি আর বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখ ৷ ধুলোর প্রকাণ্ড মেঘ ক্ষীণশ্রোত
নালার ওপর ছড়িয়ে পড়লো । পতনের প্রতিধ্বনি এখনো শোনা যাচ্ছে, শব্দটাকে ছাপিয়ে উঠলো সৈনিক আর ক্রীতদাসদের উল্লাসধবনি।
যীশুর কৃপায় কাজটা শেষ হলে।” আপনমনে বিড়বিড় করলেন ভেনাটর, তার প্রসন্ন চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো কি এক পবিত্র আলোয় । ‘বহু শতকের জ্ঞান রক্ষা পেলো । তাবু থেকে বেরিয়ে তার পাশে এসে দাড়ালো সেভেরাস। “দুঃখের বিষয়, কথাটা আমাদের সম্পর্কে খাটে না।”
ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর | “নিরাপদে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যদি ঘরে ফিরতে পারি, তারপর আর ভয় কিসের ? শারীরিক নির্যাতন আর মৃত্যু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে, চাঁছাছোলা ভাষায় বললো সেভেরাস । “আমরা সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেছি। সহজে ক্ষমা করার পাত্র থিয়োডোসিয়াস নন। সাম্রাজ্যের কোথাও আমাদের লুকোবার জায়গা! থাকবে না। উচিত কাজ হবে বিদেশে কোথাও আশ্রয় খুজে নেয়। |
‘আমার স্ত্রী আর মেয়ে… এনটিওচ-এর ভিলায় তাদের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা … ।’
“ধরে নিন ইতিমধ্যে তাদেরকে সম্রাটের লোকজন বেঁধে নিয়ে গেছে। হয় মারা গেছে, নয়তো ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দেয়া হয়েছে ।’
“অসম্ভব ! সবেগে মাথা নাড়লেন ভেনাটর, দু’চোখে অবিশ্বাস । “উচু মহলে বন্ধু-বান্ধব আছে আমার, আমি না ফেরা পর্যস্ত ওদেরকে তারা রক্ষা করবে ।’
‘এমনকি উচ্চ মহলের বন্ধুদেরকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করা যায়। ঘুষ দিয়ে দুর্বল করাও সম্ভব ।’

অকম্মাৎ কঠোর হয়ে উঠলো ভেনাটরের চেহারা । “আমরা যা অর্জন করেছি তার তুলনায় কোনে ত্যাগই বড় নয় । এখন শুধু দেখতে হবে আমরা যাতে অভিযানের রেকর্ড আর চার্ট নিয়ে ফিরতে পারি, তা না হলে সবই নিষ্পল হয়ে যাবে ।”

জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সেভেরাস, কিন্ত সে তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডারকে ছুটে আসতে দেখে চুপ করে থাকলো। ঢাল বেয়ে তীর বেগে ছুটে আসছে যুবক নোরিকাস, দুপুরের রোদে চকচক করছে তার ঘামে ভেজা মুখ, হাপরের মত হাপাচ্ছে সে, বার বার দুরবর্তী নিচু পাহাড়গুলোর দিকে হাত তুলে কি যেন দেখাবার চেষ্টা করছে ।

কপালে হাত তুলে রোদ ঠেকালেন ভেনাটর, পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালেন। শক্ত কিছু নতুন রেখা ফুটলো তার মুখে ।

“অসভ্যরা, সেভেরাস ! বদলা নেয়ার জন্যে ছুটে আসছে তারা !’

পাহাড়গুলো যেন পি’পড়েতে ঢাকা পড়ে গেছে। কয়েক হাজার অসভ্য পুরুষ ও নারী ওপরে দাড়িয়ে তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী নিষ্ঠুর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তার তীর-ধনুক সজ্জিত, হাতে চামড়ার ঢাল আর বর্শা-বর্শাগুলোর ডগা তীক্ষ করা হয়েছে কালে কাচের মতো আগ্নেয় শিলার টুকরো দিয়ে । কারো কারো হাতে কাঠের হাতলসহ পাথরের কুঠার । পুরুষদের পরনে শুধু কৌপীন। মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে সবাই, যেন কার ইঙ্গিতের অপেক্ষায়, ভাবলেশহীন, ঝড়ের পুর্ব মুহুর্তের মতো, ভীতিকর, থমথমে ।

“আরেক দল অসভ্য জড়ো হয়েছে জাহাজ আর আমাদের মাঝাখানে, হাপাতে হাপাতে বললো নোরিকাস।

ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। “তোমার বোকামির এই হলো ফল, সেভেরাস ।’ রাগে কেঁপে গেল তার গলা । “তুমি আমাদের সবাইকে খুন করলে । মাটিতে হাটু গেড়ে প্রার্থনা শুরু করলেন তিনি ।

“আপনার ঈশ্বরভক্তি অসভ্যদের ঘুম পাড়াতে পারবে না, গুরুদেব, ব্যঙ্গের স্বরে বললো সেভেরাস | “খেলা দেখাবে শুধুমাত্র তলোয়ার । ‘নোরিকাসের দিকে ফিরে তার একটা বাহু আকড়ে ধরলে সে, “দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিলো ‘বাদককে বলো বাজনা বাজিয়ে সৈনিকদের জড়ো করুক । ক্রীতদাসদের হাতে অস্ত্র তুলে দিক লাটিনিয়াস মাসার।
শক্ত চৌকো আকৃতি নেয়ার হুকুম দাও সৈনিকদের । নদীর দিকে আমরা ঝাক বেঁধে এগোবে। |”

ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে স্যালুট করলো নোরিকাস, ক্যাম্পের কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছুটলো ৷

ষাট জন সৈনিক দ্রুত ফাপা একটা চৌকো আকৃতি নিলো। সিরিযান তীরন্দাজরা থাকলো আকৃতিটার দু’পাশে, সশস্ত্র ক্রীতদাসদের মাঝখানে, বাইরের দিকে মুখ করে। রোমান সৈনিকরা থাকলো আকৃতির সামনে আর পিছনে । সৈনিকদের তৈরি পাচিলের আড়ালে, চতুভূুজের ভেতর, মিশরীয় আর গ্রীক সহকারী ও মেডিকেল টিমসহ থাকলেন ভেনাটর | পদাতিকদের জন্যে প্রধান অস্ত্র হলো গ্লাডিয়াস–দু’মুখো তীক্ষ ডগা তলোয়ার, বিরাশি সেন্টিমিটার লম্বা । আর আছে ছুঁড়ে মারার জন্যে দু’মিটার লম্বা বল্লম । শারীরিক নিরাপত্তার জন্যে সৈনিকরা লোহার হেলমেট পরেছে। হেলমেটের কিনার গালের দু’পাশে ঝুলে আছে, দুটো প্রান্তকে বাধা হয়েছে চিবুকের কাছে । খাঁচা আকৃতির লোহার বেড় দিয়ে বুক, কাধ আর পিঠেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যস্ত লম্বা হাড়টাকে রক্ষার জন্যে আছে লোহার গার্ড । তাদের ঢালগুলো কাঠের তৈরি । পাহাড় থেকে হুড়মুড় করে নেমে না এসে আস্তে ধীরে কলামটাকে………

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top