একটু চোখ বুলিয়ে নিন
মায়ামি স্টেডিয়াম লোকে লোকারণ্য । মাঠে তুমুল উত্তেজনা, এইমাত্র একটা গোল করে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। কয়েক মুহুর্তের জন্যে থমকে গেলেও, ধাক্কাটি সামলে নিয়ে প্রাণপণ লড়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে বয়েজ কাব।
মার্কিন মুল্লুকে ফুটবল এখনও জনধিয় খেলা নয়, তবে আজকের ঘটনাটা ব্যতিক্রম। দেড় মাস ধরে প্রতিটি দৈনিকে ফলাও করে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, টিভির স্পোর্টস প্রোগ্রামে নিয়মিত প্রচার করা হয়েছে দু’দলের আস্ফালন!
বয়েজের কর্মকর্তারা তো গতকালের সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, ম্যারাডোনা তাদের হয়ে খেলতে আসতে পারেন না, একথা নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। ব্যাপারটা নিয়ে ভারি দুশ্চিন্তায় ছিল মায়ামি মোহামেডান,
কারণ সবাই জানে ম্যারাডোনার মত সুপারস্টারকে প্রতি মিনিটের জন্য ত্রিশ হাজার ডলার দিয়ে খেলাবার সামর্থ সিটি বয়েজের আছে–ওদের বেশিরভাগ পৃষ্ঠপোষক আর সমর্থক প্রবাসী সৌদি শেখ আর কুয়েতি আমির, তাদের ব্যক্তিগত উদ্যেগেই ক্লাবটার জন্ম। মায়ামি মোহামেডানও নতুন ক্লাব- প্রবাসী ইরাকী, ভারতীয় ও বাংলাদেশীদের পরিশ্রমের ফসল। সিটি বয়েজ কোচ আনিয়েছে পশ্চিম জার্মান থেকে, মোহামেডান আনিয়েছে ব্রাজিল থেকে, খেলোয়াড়রা অবশ্য প্রায় সবাই স্থানীয়, সাদা কালো উভয় রঙই আছে।
গোলের এমন ছড়াছড়ি, বলা যায় প্লাবন বয়ে বাচ্ছে। শেষ গোল হওয়ার পর দেড় মিনিটও পেরোয়নি, দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শেষ হতে আর এগারো, মিনিট বাকি, আবার একটা গোল হলো । দলীয় গোল সংখ্যা উনিশ, এক গোলে এগিয়ে গেল মোহামেডান স্পোর্টিং। সত্তর হাজার দর্শকের সাথে উল্লাসে ফেটে পড়ল মাসুদ রানা, সবার সাথে একযোগে দাঁড়িয়ে পড়ে হাততালি দিচ্ছে আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।
ওর ঠিক পিছনের সারিতেই সীটের ওপর উঠে দাড়িয়ে উদ্ধাহু নৃত্য করছিল ছোটখাট এক হালকা পাতলা লোক। হ্যাট- কোট আব সানগ্লাসের আড়ালে আসল চেহারা ঢাকা পড়ে আছে, বাংলাদেশী বলে চেনার উপায় নেই। মাইরি বলছি, জানতুম মুক রক্কে হবেই । মুহমেডান জিন্দাবাদ! খুলে নে ভাই, খুলে নে, পাতলুন খুলে ন্যাংটো কবে ছেড়ে দে শালাদের…। হঠাৎ সামনের দীর্ঘদেহী যুবককে চিনতে পেরে আঁতকে উঠল সে, কোঁক করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা থেকে যেন তলপেঠে লাথি খেয়েছে। এমনভাবে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল সে, যেন জ্বলন্ত কুশ পুত্তলিকায় পানি ঢেলে দেয়া হয়েছে। বসে পড়ল টুপ করে।
শান্ত হয়ে এল গ্যালারি, আর সবার সাথে বসে পড়ল রানা । তুমুল শোরগোলের মধ্যেও গিলটি মিয়ার গলা চিনতে পেরেছে ও । কোন কারণ নেই, তবু একটু যেন লজ্জা পেয়েছে, সেজন্যে চেহারায় গম্ভীর একটা ভাব টেনে আনল।
কাছাকাছিই বসেছে ওরা, কোন সন্দেহ নেই কাকতালীয় একটা ঘটনা ।
বাংলা তো নয়ই, অন্য কোন ভাষাও ভাল লিখতে, পড়তে বা বলতে জানে না গিলটি মিয়া। তবে হিন্দী, উর্দু, বাংলা, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ইত্যাদি শব্দ সহযোগে অদ্ভুত এক ভাষা বানিয়ে নিয়েছে সে, ভাব প্রকাশের জন্যে
বেশ সহায়ক প্রমাণিত অঙ্গভঙ্গিও কিছুটা অবদান রাখে । লন্ডন থেকে প্রকাশিত, বাংলাদেশী মালিকানাধীন. একটা ইংরেজী পত্রিকায় অনেকদিন ধরে চাকরি করছে সে। পত্রিকাটি আসলে বি. সি. আই. ও রানা এজেঙ্গির একটা ফ্রন্ট,
কাজের সুবিধের জন্যে দেশী এজেন্ট আর অপাবেটররা এখানে নামকাওয়াস্তে চাকরি করে। মায়ামিতে রানা এজেন্সির নতুন শাখা উদ্বোধন করা হয়েছে গত হস্তায়, শাখা অফিসের বাইরে থেকে সাহায্য করবার বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে গিলটি মিয়াকে । মায়ামি শাখায় প্রকাশ্যে বসবে না সে।
‘রাকে আল্লা মারে কে!’ রানার পিছন থেকে বিড়বিড় করে উঠল গিলটি মিয়া। ‘মনে হচ্ছে শেক সায়েবকে দু’হাজার ডলার হারতেই হলো!
সিটি বয়েজের একজন পৃষ্ঠপোষক সৌদি এক শেখ রানার বন্ধু, দু’হাজার ডলার বাজি ধরেছে ওরা ।
একটা নেট ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের দুটো কাপ বের করল গিলটি মিয়া, ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালল কাপে। কফি, সার চলবে তো?”
“মাসুদ রানা, রাইট?” বেসুরো “গলা, কিন্তু সবিনয়ে করা হলো প্রশ্নটা । মায়ামি এজেন্সির ডিরেক্টর, ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে ওরও ছবি ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায় ।
পশ্চিম গ্যালারির চার নম্বর ধাপে বসেছে রানা, পাশেই লোক চলাচলের সিঁড়ি । মুখ তুলে তাকাল ও।
শক্ত-সামর্থ চেহেরার একজন জাপানী, পরনে লাল-নীল ডোরাকাটা শার্ট, হাতে ক্যামেরা, ভদ্র চেহেরা, রানার দিকে তাকিয়ে সমীহের সাথে হাসছে। হাঁ, চিনতে ভুল করেননি, বলল রানা, পিছন থেকে বাড়ানো গিলটি মিয়ার হাত থেকে কপির কাপটা নিল।
গ্রেট প্রাইভেট আই, মায়ামি মোহামেডানের ওয়ান অভ দ্যা গ্রেট পেট্রনস-স্যার, জাপানী পাঠকরা আপনার সম্পর্কে জানতে পারলে কৃতার্থ রোধ করবে। ছবি তুলতে পারি তো?’ অনুমতি চাইল, কিন্তু পাবার অপেক্ষায় থাকল না স্থির, সবিনয় হাসিটা ঠোট ধরে রেখে সিঁড়ির একটা ধাপ বেয়ে নেমে গেল জাপানী লোকটা, ক্যামেরা তুলল চোখের সামনে ।
চেচিয়ে উঠল গিলটি মিয়া, “সা-আ-আ-র! সাবধান!’
ফটোগ্রাফারের হাসি টান টান হলো ।
রানার কাধের ওপর দিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গিলটি মিয়া, আঙুলগুলো ছড়ানো । রানার বুক আর গলা জড়িয়ে ধরে পিছন দিকে টান দিল সে, শুইয়ে ফেলতে চেষ্টা করল। বিদ্যুৎ খেলে গেল রানার শরীরে, গিলটি মিয়ার আলিঙ্গন থেকে স্যাৎ করে বেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে পড়ল ও । সিড়িতে শরীরটা বাড়ি খাওয়ার আগেই মৃদু আওয়াজটা কানে ঢুকল- পুপ! মাথা না ঘামিয়েই বুঝতে পারল, সাইলেন্সের লাগানো মিডিয়াম-ক্যালিবারের একটা পিস্তল থেকে ওর দু’চোখের মাঝখানে করা হয়েছিল গুলিটা । রানা ডাইভ দেয়ায় ওর কাধের সাথে গিলটি মিয়ার ডান কনুই ঠুকে গেল, কাপ থেকে ওপর দিকে খাড়া হলো কফি, অনুসরণ করল রানাকে । সিঁড়ির ধাপের ওপর পড়েই গুটানো স্প্রিঙের মত হয়ে গেল ও, ঠিক তখনই বৃষ্টির মত চোখে মুখে ঝরে পড়ল গরম কফি। ওর পিছনে কিশোরী দুটো মেয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল।
টার্গেটকে দ্রুতবেগে স্থান বদল করতে দেখে মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত বোধ করল ফটোগ্রাফার, আরও এক ধাপ নেমে গিয়ে আবার ক্যামেরা তুলল চোখের সামনে । গুটানো স্প্রিঙ খুলে গেল, চার ধাপ ওপর থেকে ফটোগ্রাফারের বুকে যেন বজ্রপাত ঘটল। রানার জোড়া পায়ের কিক খেয়ে নিচের চওড়া প্যাসেজ পেরিয়ে কাটাতারের বেড়ার ওপর পড়ল জাপানী লোকটা ধাপগুলোর,ওপর দিয়ে পিছলে প্যাসেজে তার সামনে এসে থামল রানা । সিধে হয়ে দাড়াতে শুরু করেছে, লোহার মত কঠিন একজোড়া হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল ফটোগ্রাফার।
“সার, ইদিকে আরেক নাক-চ্যাপ্টা!’
রানার কোমর আর পেট জড়িয়ে ধরেছে লোকটা, পাজরে মাথা ঠেকিয়ে রানাকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। গিলটি মিয়ার কথা শুনে ঝট্ করে গ্যালারির দিকে তাকাল রানা, আরও একজন জাপানী ফটোগ্রাফার, ওর মতই লম্বা, সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে উবু হয়ে বসে রয়েছে, চোখে ক্যামেরা-যেন মারপিটের ছবি তুলতে চায়। ভাজ করা হাটু দিয়ে প্রথম লোকটার তলপেটে গুতো মারল রানা, ছিটকে দুরে সরে যাচ্ছে দেখে লাল-নীল ডোরা কাটা শার্টটা বুকের কাছে খামচে ধরল, হ্যাচকা টানে কাছে এনে একটা পা বাধাল ওর তলপেটে, তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে পায়ের ধাক্কায় মাথার ওপর দিয়ে ছুড়ে দিল দ্বিতীয় লোকটার দিকে । গোটা স্টেডিয়াম বিস্ফোরিত হলো, আরেকটা গোল দিয়েছে মায়ামি মোহামেডান।
কাটাতারের নিচু বেড়া টপকে সবুজ ঘাসে লাফিয়ে পড়ল রানা, সাদা রেখা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল খেলার মাঠে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাল একবার, ইতোমধ্যে লম্বা লোকটা উঠে দাড়িয়েছে, সিড়ির কয়েকটা ধাপ ওপর থেকে রানার দিকে লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করছে সে। এক মুহূর্ত পর মোহামেডান স্পোর্টিঙের পৃষ্টপোষক সাহেব খেলোয়াড়দের সাথে মিশে গেল । সে-ও দৌড়াচ্ছে, তবে বলের পিছনে নয়।
কাটাতারের বেড়া টপকে ঘাসে নামল দ্বিতীয় আতাতায়ী। মাঠের কিনারা ধরে ছুটে আসছে সে।
বল এখন মধ্য মাঠে, মোহামেডানের লিঙ্কম্যান সেটাকে পায়ে নিয়ে রানার মতই হিসেব করছে। কোনাকুনি মাঠ পেরিয়ে সিটি বয়েজ কর্মকর্তাদের বেশি নয় কর্মকর্তাদের মাঝখানে ঢুকে যেতে পারে রানা, ধরে নোট পারে লুকানো পিস্তলটার রেঞ্জ খুব বেশি নয়। কর্মকর্তাদের সাথে সিটি বয়েজের অতিরিক্ত খেলোয়াড়রাও বসে আছে, ওদের সাহায্য নিয়ে জাপানী আততায়ীকে ভয় পাইয়ে ভাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ঠিক তা চাইছে না রানা। ওকে জানতে হবে কেন, কার হুকৃমে গুলি করা হচ্ছে।
ভুল পাস, বল চলে গেল সিটি বয়েজের একজন খেলোয়াড়ের পায়ে। মারমুখো হয়ে রানার দিকে ছুটে আসছে রেফারি। মোহামেডানের একজন খেলোয়াড় ও ছুটে আসছিল, রানাকে চিনতে পেরে হাঁ করে গেল সে। মাসুদ ভাই, আপনি…
মাঠের কিনারায় বসা সিটি বয়েজের কর্মকর্তারা উঠে দাঁড়িয়েছে, দু’দিক থেকে ছুটে আসছে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল রানা। সিটি বয়েজের দু’জন খেলোয়ার ওর পথরোধ করে দাঁড়াল। ডানদিকে যাবার ভান করে বা দিকে গিয়ে তাদের এড়াল ও। পুলিশের হুইশেল বাজছে। সিটি বয়েজের কর্মকর্তারা নিরেট পাঁচিল তৈরি করার আগেই তাদের ভিতর দিয়ে তীর বেগে বেরিয়ে এল রানা। বুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচকে। দৃশ্যটা দেখে সামনে থেকে ছিটকে সরে গেল একজন প্রেস ফটোগ্রাফার। কাটাতারের বেড়ার মাঝখানে একটা ফাঁক দিয়ে ঢুকে লকার রুমগুলোর দিকে ছুটল রানা। গ্যালারির দর্শকরা ওর দিকে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু কেউ বাধা দিল না। সিড়ির পচিশ ধাপ ছয়-সাত লাফে টপকে গ্যালারির মাথায় উঠে এল ও । ইউনিফর্ম পরা একজন স্টেডিয়াম কর্মী দু’হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে বাধা দিল, কিন্তু রানার চেহারা লক্ষ করে স্যাৎ করে সরে গেল একপাশে । খেলা আবার শুরু হয়েছে ।
সামনে একজন পুলিসকে দেখে টয়লেটে ঢুকে পড়ল রানা । একজন স্টেডিয়াম কর্মী ছাড়া অন্য কোন লোক নেই ভেতরে । ঝট্ করে তাকে পরিচয়-পত্রটা দেখাল । “ব্লেজারটা ভাড়া দাও, পাঁচ মিনিটে পঞ্চাশ ডলার রোজগার করো, রাজি? স্বাস্থ্যবান যুবকের দিকে দশ ডলারের পাচখানা নোট বাড়িয়ে দিল। “একজন ব্যাংক ডাকাতকে ফলো করছি, ভাই । ব্যাটার পাশে গিয়ে চুপটি করে বসতে চাই ।’
প্রথমে টাকা নিল যুবক, তারপর ব্লেজার আর স্ট্র হ্যাট খুলল। ব্লেজারটা ফিট করলেও, হ্যাটটা বড় হলো একটু । পাচ মিনিট পর এক নম্বর গেটে দেখা করতে বলে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এল রানা । পুলিসটাকে আবার দেখল, এদিকেই হেটে আসছে, তবে ওর দিকে ভাল করে তাকালই না। গ্রাউন্ড লেভেলে. নেমে- এসে একজন টিকেট চেকারকে পাশ কাটাল রানা, সে-ও ওর মত উজ্জল ইউনিফর্ম পড়ে আছে। “খেলাটা মিস করছ, তাকে বলল ও।
“টিভিতে দেখে নেব ।’
স্টেডিয়াম আর পার্ক করা হাজার হাজার গাড়ির মাঝখানে কংক্রিটের মস্ত চাতাল। হন হন করে চাতালটা পার হচ্ছে রানা । সত্তর হাজার দর্শক একযোগে গুঙিয়ে উঠল, সম্ভবত কড়া একটা কিক ধরে ফেলেছে গোলকীপার। পার্কিং এরিয়া রেলিং দিয়ে ঘেরা, গেটের সামনে চাতালের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে রয়েছে লম্বা একটা বাস, সম্ভবত এটাতে চড়েই হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে এসেছে খেলোয়াড়রা ।
বাসটা খালি, ড্রাইভারও সম্ভবত খেলা দেখছে । দরজা খোলা রেখেই ড্রাইভিং সীটে বসে পড়ল রানা, ইগনিশন সুইচ অন করল। ইনস্টুমেন্ট প্যানেলে জ্বলে উঠল লাল আলো।
সাফল্যের অনেকগুলো চাবিকাঠির একটা, অপরাধীর চিন্তাধারা নির্ভুল আন্দাজ করতে পারে রানা । ওকে মাঠ পেরোতে দেখে জাপানী আততায়ীরা ধরে নেবে, গাড়ি থেকে নিজের পিস্তল আনতে গেছে ও। ইনভেস্টিগেটিং ফার্মের এজেন্টরা সাধারাত গাড়িতেই অস্ত্র রাখে । রানাও রেখেছে বটে, কিন্তু গাড়িটা পার্কিং এরিয়ার একেবারে শেষ মাথায়, খালি হাতে অতটা দুরত্ব পেরোবার ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ও। আর দু’এক মুহূর্ত পর, ওর আন্দাজ যদি ঠিক. হয়, সামনের একটা বাক থেকে বেরিয়ে আসবে জাপানী আততায়ীদের একজন, হাতে রেডি থাকবে ক্যামেরা, চোখ থাকবে গেটগুলোর দিকে ।
অন্যমনস্কভাবে সিগারেটের জন্যে পকেটে হাত ভরল রানা, পেল না। ধস্তাধস্তির সময় পড়ে গেছে। ব্লেজারের পকেটে চ্যাপ্টা একটা প্যাকেট রয়েছে, সস্তাদরের সিগারেট! ধরাতে যাবে, একটা গেট দিয়ে ছোটখাট জাপানী লোকটা
চওড়া চাতালে বেরিয়ে এল। চাতালের মাঝখানে দাড়িয়ে স্টেডিয়ামের দিকে ফিরল সে, গেটগুলোর দিকে সতর্ক নজর রাখছে।
” মাঝখানের দূরত্বটুকু বিবেচনা করল রানা । ছুটে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলা যায়, শব্দ পেয়ে ওর দিকে ক্যামেরা তাক করার চেষ্টা করবে, ততক্ষণে তার গায়ে গিয়ে পড়বে ও।
রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল রানা । কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ঠিক তখনই ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল লোকটা। মাথা নিচু করে নিল রানা, হ্যাটের কার্নিসে মুখের ওপরের.-অংশ ঢাকল। ঘাড় সোজা করল লোকটা, পরমুহূর্তে আবার বাকা করল।
স্টেডিয়ামের দিকে পিছন ফিরল জাপানী । বাসের দিকে এক পা এগোল।
স্টার্টারে হাত-ঝাপটা মারল রানা, একই সাথে চাপ দিল গ্যাস পেডালে। গর্জে উঠল মটর | গেট পেরিয়ে স্যাৎ করে বেরিয়ে এর বাহান্ন সীটের বাস, ইতোমধ্যে চোখের সামনে ক্যামেরা তুলে ফেলেছে আতাতায়ী।
কোমর থেকে ওপরের অংশ ডান দিকে কাত করল রানা। উইন্ডস্ক্রীন ফুটো করে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গল একটা বুলেট, ঝাপসা হয়ে গেল কাচ । আবার একবার গুঙিয়ে উঠল সত্তর হাজার দর্শক । গাড়ির মেঝের সাথে গ্যাস পেডাল চেপে ধরল রানা, স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে বা হাতে । আবার গুলি করল আততায়ী।
কিন্তু রানাকে সে দেখতে পাচ্ছে না।
দুর্জয় সাহস লোকটার । বাসের তুলনায় অনেক কম গতিতে পিছু হটছে সে, দু’হাতে ধরা ক্যামেরা মাথার ওপর তুলে আরেকটা গুলি করল” পরমুহূর্তে তাকে ধাক্কা দিল বাসটা, চাতাল থেকে তুলে দূরে ছুঁড়ে দিল, তারপর পিষে চ্যাপ্টা করে দিল কংক্রিটের সাথে।
দুই
দু’হাতের আঙুল মটকাচ্ছে মরিস ওয়েস্ট, তাকিয়ে আছে ডেস্কের ওধারে বসা স্নেহভাজন যুবকের দিকে । সৎ অথচ নির্বোধ নয় এমন পুলিস অফিসার খুব কমই দেখা যায়, মরিস ওয়েস্ট তাদের একজন। সবাই জানে, মায়ামি পুলিস প্রধান প্রয়োজনে কঠোর হতে পারে; তার সাহসেরও কোন অভাব নেই।
রানা এজেন্সির কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে ভাল ধারনা আছে তাঁর, মায়ামিতে বদলি হওয়ার আগে ‘ নিউ ইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে ওদের সাহায্য সহযোগিতা প্রচুর পেয়েছে সে। হাসল না, শুধু একটু কাধ ঝাকাল, তারপর বলল, “বেশ। কিছু জানাতে না চাও জানিয়ো না।
ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন, মি. ওয়েস্ট, শান্ততাবে বলল রানা । “ওদের সত্যিই আমি চিনি.না।
“দু’জন আততায়ী তোমাকে খুন করার চেষ্টা করল, অথচ কারণটা তোমার জানা নেই? আন্দাজ করতে পারছ না এখানে, মায়ামিতে, কে বা কারা তোমার প্রাণের শত্রু হতে পারে?
“তেমন কারও কথা, কই, আমার মাথায় আসছে না। তবে আমেরিকায় অনেক লোকেরই পা মাড়িয়েছি, তাদের কেউ মায়ামিতে আস্তানা গেড়ে থাকতে পারে।
আমি তাহলে ধরে নেব, পুলিশের সাহায্য তুমি চাইচ না?
আমি রিপোর্ট করেছি, তাই না? এরপর আপনারা কি করবেন না করবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার । আমার প্রোটেকশনের কথা যদি বলেন’-“।’
একটা হাত তুলে রানাকে থামিয়ে দিল পুলিস প্রধান। “জানি, প্রোটেকশন দিয়ে বেড়াও তোমরা, চেয়ে বেড়াও না।’
“আর যদি রহস্যের কিনারা করতে চান, আমার ওপর নজর রাখার জন্যে একজন লোককে লাগাতে পারেন, বলল রানা।
‘এটা ধরে নিয়ে যে আবার তোমার ওপর হামলা হবে, তখন আততায়ীকে আটক করতে পারব? কিন্তু তোমাকে চিনি, আমার লোকের চোখে ধুলো…।
‘হেসে ফেলল রানা । “হাবভাবেই ধরা পড়ে যায় ওরা পুলিস। সেজন্যেই তো বলছি, এত সব ঝামেলার মধ্যে নাই বা গেলেন। একটা কথা পরিষ্কার জানুন-কে গুলি করেছে, কার হুকুমে, কেন-সব আমাকে জানতে হবে । আমি জানলে
আপনিও জানবেন ।” হাতের সিগারেট আশট্রেতে গুজল রানা।
“আর এক মিনিট, রানা । গোটা ব্যাপারটা আরেকবার ম্মরণ করো । একজন ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে চাওয়ায় তুমি না বলতে পারোনি। ব্যাপারটা তুমি পছন্দ না করলেও, যে-কেউ ছবি তুলতে চাইতে পারে। কেউ চাইলে, ক্যামেরার দিকে সম্দেহের চোখে তাকানোরও কথা নয়। কিন্তু রিপোর্টার ভদ্রলোক, গিলটি মিয়া-কি অদ্ভুত নাম, তাই না? কথাতেই তো আছে এক দেশের বুলি, আরেক দেশের গালি- একটা বৈসাদৃশ্য লক্ষ করে তোমার মুখের সামনে হাত আসে, বত্রিশ ক্যালিবারের গুলি লেগে বেচারার কজি ভেঙে গেছে। গুলিটা তোমার দু’চোখের মাঝখানে লাগতে পারত !’
“কি ঘটেছে আমার মনে আছে ।’
“বেশ, ওদের একজনকে বাস চাপা দিয়েছ তুমি। হাতের কাছে আর কিছু পাওনি, বাহান্ন সীটের বাস দিয়ে মেরেছ। আত্মরক্ষার জন্যে সে অধিকার তোমার আছে। বেশ ভাল । কিন্তু ছিতীয়বার, তৃতীয়বার বা চতুর্থবার এই একই ঘটনা ঘটবে তার নিশ্চয়তা কি? একরার যদি ওরা যায়?
“মানে আমি যদি মারা পড়ি?
“পড়তে পারো, তাই না? অমর তো আর নও।’
‘জরুরী একটা কাজের কথা তুলেছে, মি. ওয়েস্ট। মৃত্যুর কথা সত্যি কিছু বলা যায় না। ঘটনাটা আপনার এলাকায় ঘটলে দয়া করে ঢাকায় পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন লাশটা–।’
“তুমি খুব হালকাভাবে নিচ্ছ ব্যাপারটাকে, রানা । ক্যামেরাটা দেখেও কি তুমি বুঝতে পারছ না, সিরিয়াস লোক লেগেছে তোমার পিছনে?’ ডেস্ক থেকে অদ্ভুত দর্শন ক্যামেরাটা হাতে নিল সে, লুকানো একটা বোতামে চাপ্র দিতেই লাফ দিয়ে খুলে গেল কেস, বেরিয়ে পড়ল ছোট ব্যারেলের একটা রিভলভার। সাধ্যরণ কাজ নয়। কাছ থেকে, ভিড়ের মধ্যে দাড়ানো বা বসা কোন লোককে মারতে হলে এরচেয়ে ভাল অস্ত্র হতে পারে না।’
“সম্পূর্ণ একমত ।’
‘দু’জন জাপানী লোক, এ-ও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। যাকে মেরেছ তার পকেটে খেলার টিকেট ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। ওয়াশিংটন কমপিউটরে তার আঙুলের ছাপও নেই । আর যে পালিয়েছে, পুলিস রেকর্ড থাকলে ধরা পড়বেই।
তবে আমার সন্দেহ আছে । এরা বিদেশ থেকে আমদানী করা লোক ।’
‘জানি।’ অধৈর্য ভাবটুকু চেপে রাখল রানা । “মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চান আপনি।
“গোটা ব্যাপারটা থেকে টাকার,গন্ধ বেরুচ্ছে, রানা । এই ঘটনার পিছনে বড় একটা নেপথ্যকাহিনী আছে-আন্তর্জাতিক মানের । কাজেই তুমি কিছু জানো না।
এ ঠিক বিশ্বাস্য নয়। নিউ ইয়র্কের সেই নারকোটিক চুরির কেসটার কথা আমি ভুলিনি বিভিন্ন সরকারী ওয্যার হাউস থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি ডলারের ড্রাগস চুরি যাচ্ছিল রহস্যের কিনারা করতে না পরে খাবি খাচ্ছিল পুলিস। কি যেন নাম লোকটার? ব্র্যাডম্যান কি যেন…।
ব্যাডম্যান তার নামের শেষ অংশ’ নির্লিপ্ত সুরে বলল রানা । কিন্তু তাকে ধরা তো দূরের কথা, তার ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে পারিনি আমি।’
হাতেনাতে চোরদের ধরতে পারতে, তা না ধরে ওদের তুমি ফলো করো, অপরাধীরা গ্যাস ব্যবহার করে, গার্ডরা সবাই অজ্ঞান হয়ে যায়। তুমিও গার্ডের ছদ্মবেশে ছিলে ওয়্যার হাউসে, কিন্তু সাথে গ্যাস মাস্ক ছিল। ট্রাকে ড্রাগস ভরে ওরা, তারপর চলে যায়। ওদের চোখে দুলো দিয়ে ট্রাকের পিছনে উঠে পড়ো তুমি
তারপর…।
‘একটু সংক্ষেপ করলে হয় না?’
ট্রাক ব্র্যাডম্যানের ওয়্যার হাউসে পৌঁছুল-“।
ওয়্যার হাউসটা কে ভাড়া করেছিল জানা যায়নি, বলল রানা । “চোররাও জানত না কে তাদের মনিব, কিংবা জানলেও স্বীকার করেনি।’
কিন্তু তখন ব্যাডম্যান’ সম্পর্কে তথ্য পাবার জন্যে অস্থির থাকতে দেখা গেছে তোমাকে । এ থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি, ওয়্যার হাউসটা ব্রাডম্যানের ছিল বলেই তুমি বিশ্বাস করতে ।’
রানা চুপ করে থাকল।
“তোমার কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিস পৌছুল, ব্র্যাডম্যানের ওয়্যার হাউস থেকে শুধু ড্রাগস নয়, তিন টন সোনাও উদ্ধার করল তারা । অর্থাৎ লোকটার সর্বনাশ করলে তৃমি” কিন্তু সে তোমাকে কিছু বলল না, একটা টিল পর্যস্ত ছুড়ল
না। আশ্চর্য নয়?
‘আপনি বলতে চাইছেন প্রায় এক বছর পর লোকটার হঠাৎ মনে হয়েছে, প্রতিশোধ নেয়া দরকার?
“মনে আগেই হয়েছে, সুযোগের অপেক্ষায় ছিল । ব্র্যাডম্যান হয়তো মায়ামিতে কাজ করছে এখন, এখানে রানা এজেন্সির শাখা খোলা হয়েছে দেখে ভাবছে আর দেরি করা উচিৎ নয়।
কথা না বলে আরেকটা সিগারেট ধরাল রানা।
মৃত্যুটা কিন্তু খুব জাঁকাল হত তোমার, রানা । সত্তর হাজার সাক্ষীর সামনে ।’
“ধন্যবাদ, মি. ওয়েস্ট, শান্তভাবে বলল রানা ।
“লোকটা গভীর জলের মাছ, রানা । আন্তর্জাতিক চরিত্র। তাকে আমি বিপজ্জনক বলি এই জন্যে যে লোকটা আডভেঞ্চার প্রিয় বলেই অপরাধ জগতে আছে। শুধু যে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক তাই নয়, প্রভাব আর যোগাযোগও ব্যাপক ।’
হ্যা, অপরাধ করে মজা পায় লোকটা, বিড়বিড় করে বলল রানা । মুখ তুলে পুলিস চীফের দিকে তাকাল। ‘আমাকে তাহলে কি করতে হবে?
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।