একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
বিশে মার্চ উনিশশো নিরানব্বুই । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৷
আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে দুধ সাদা সমুদ্রের মাঝখানে সয়্যার এয়ারফোর্স বেস যেন বহু রঙা একটা দ্বীপ। মিশিগান উপদ্বীপের উঁচু বনভৃমি বরফে ঢাকা পড়ে আছে, তিনশো চৌত্রিশ মাইল দীর্ঘ বনভূমিকে ঘিরে আছে তিনটে বিশাল লেক, পাহাড়-সমান উচু তুষারের স্তর মন্থর বেগে ধসে পড়ছে পাড় থেকে। বিশাল ভূখণ্ডের মাঝখানে একমাত্র সয়ারে কোন বরফ জমতে দেয়া হয়নি। ঘাটির বাইরে মেইন রোডের বরফ পরে পরিষ্কার করা হবে, রাজ্য সরকার যদি স্নোপ্রাউ কেনার জন্যে যথেষ্ট টাকা যোগান দিতে পারে। তা না হলে বসস্তের আগে পর্যন্ত গোটা এলাকা বরফে ঢাকা থাকবে । এবং বসন্ত আসতে এখনও দেরি আছে।
মারকুয়েটি থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে সয়্যার একটা স্ট্রাটেজিক এয়ার কমান্ড বেস, অফিশিয়ালি কাজ শুরু করেছে উনিশশো অষ্টাশি সালে, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে এটাই এ-ধরনের শেষ সামরিক স্থাপনা । মধ্যপ্রাচ্যের তেলের
মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসায় (সত্তর দশকে মজুদ তেলের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল হিসেব দেয়া হয়েছিল), এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায়, সব ধবনের এনার্জির ওপর রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এক গ্যালন গ্যাসোলিনের দাম পড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারো ডলার, ইউরোপে প্রায় দ্বিগুণ।
ষাট আর সত্তর দশকে স্ট্রাটেজিক এয়ার কমান্ডের প্রায় অর্ধেক প্লেন সবসময় আকাশে থাকত, এখন ফাইটার-বম্বার সবগুলো মাটিতে থাকে । অনুশীলন মহড়ার সময় এই অভাবের যুগেও আগের মত সমস্ত ক্র আর সহকারীদের ডাকা হয়, কিন্ত সবাই এবং সব কিছুর হয়ে তাকে ফ্লাইট লাইনে। রক্ষণাবেক্ষণে কোন ত্রুটি না থাকলেও ফুয়েল বাচানোর জন্যে প্লেনগুলোকে আকাশে তোলা হয়না!
রূপালী ডানার চিলের মত প্লেনগুলো, ভীতিকর অথচ মসৃণ সৌন্দর্যের প্রতীক, সার সার দাড়িয়ে আছে ট্যাক্সিওয়েতে। ওগুলো এফ-বি/একশো উনিশ, একশো বিশ জার একশো উনত্রিশ, খানিক আগে টেনে পজিশনে নিয়ে এসেছে মাঠ কমীরা । ককপিটে পাইলট আর নেভিগেটররা বসে আছে । কালেভদ্রে কোন দিন যদি প্লেন নিয়ে আকাশে ওঠার সুযোগ ঘটে, ওদের জন্যে উৎসব হয়ে ওঠে দিনটা, জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর মত।
কোদাল, শাবল, আর স্নোপ্লাউ দিয়ে সারাক্ষণ রানওয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে!
হুংকার ছাড়ছে ননকমিশনড অফিসাররা । অনুশীলন মহড়ার শুরুতে দুটো স্নোপ্লাউয়ের একটা ভেঙে গেছে, ফলে রানওয়ে পরিষ্কার করতে দেরি হচ্ছে। টেক-অফের নির্দিষ্ট সময় পিছয়ে দিতে হবে।
পারকা পরা আটজনের একটা দলের দিকে মারমুখো হয়ে ছুটে এল একজন স্টাফ সার্জেন্ট । “হাত দিয়ে সরাবে নাকি পাছা দিয়ে, আমি জানি না-আধ ঘণ্টার মধ্যে রানওয়ে সাফ হওয়া চাই!’ এয়ারম্যানদের একজন শিরদাডা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে ছিল, সার্জেন্টকে দেখে শাবলের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল সে। ঘন ঘন ঝাকাতে শুরু করল মাথাটা ।
রেগেমেগে তার দিকে ছুটে এল সাজেন্ট। “এই যে, তুমি! বাতাসে গুতো মারার আর সময় পেলে না!”
এয়ারম্যান লিটারের মুখের চেহারা লালচে হয়ে আছে, এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও ঘামছে সে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার, চোখ পিট পিট করে সার্জেন্টের দিকে তাকাল । ‘সার্জেন্ট জড়ানো গলায় বলল সে, “আমার খারাপ লাগছে”…
হ্যা, আমিও অসুস্থ… আমার মাথা আর বুক ব্যথা করছে, সার্জেন্টের পাশ থেকে আরেকজন এয়ারম্যান বলল, কোদালের হাতলটা বুকের কাছে ধরে আছে সে |
‘ই. এম, ক্লাবে কাল রাতে বুঝি খুব গিলেছ?’ খেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করল সার্জেন্ট।
দলের সবাই কাজ বন্ধ করে ওদের কথা শুনছে। প্রশ্নের উত্তরে এয়ারম্যান দু’জন মাথা নাড়ল। মদ খায়নি ।
“তাহলে? কি হয়েছে তোমাদের?
জবাব না দিয়ে আবার শুধু মাথা নাড়ল ওরা দু’জন।
‘অ্যাই, তোমরা কাজ করো । আমি দেখছি কি হয়েছে এদের।” হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল সার্জেন্ট । ‘বেস কমান্ডার আমার ছাল তুলবে! শালার স্নোপ্লাউ আর ভাঙার সময় পেল না!’ এয়ারম্যান দু’জনের দিকে আবার ফিরল সে। “হ্যাঁ,
বলো, কি হয়েছে তোমাদের?
‘বুকে ব্যথা, সার্জেন্ট, শ্বাস নিতে পারছি না। চোখে ঝাপসা দেখছি।’
দ্বিতীয় লোকটা বলল, ‘মাথা ঘুরছে।”
“বোঝাই যাচ্ছে, সুস্থ নও, মেনে নিল সার্জেন্ট। “কাজের সময়, সুস্থ থাকবে কেন! যাও হাসপাতালে গিয়ে বলো…” প্রথম এয়ারম্যান হঠাৎ গুঙিয়ে ওঠায় মাঝপথে থেমে গেল সে । যুবকের চোখ উল্টে গেল, কেউ ছুটে এসে ধরে ফেলার আগেই সটান আছাড় খেয়ে বরফের ওপর পড়ল সে। টলতে টলতে সঙ্গীর দিকে এগোল দ্বিতীয় এয়ারম্যান, তার পাশে হাটু ভাজ করে বসতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে-ও, যেন কোন হাড় নেই।
‘গ্রাফটন; শিগগির!” দলের একজনের নাম ধরে ডাকল সার্জেন্ট । ‘টাওয়ারে গিয়ে হাসপাতালে ফোন করো, জলদি! লিটারের জন্যে আ্যাস্বুলেন্স দরকার!” দ্বিতীয় এয়ারম্যানের দিকে তাকাল সে। লোকটা হাপাচ্ছে, তারও চোখ উল্টে গেছে।
‘দু’জনের জন্যেই!’
টাওয়ারের দিকে দৌড় দিল গ্রাফটন।
হঠাৎ খেয়াল করল সার্জেন্ট, বরফ ভাঙার আওয়াজ হচ্ছে না। ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে দলটার দিকে তাকাল সে । “কি হলো, তোমরাও অসুস্থ হতে চাও?
উত্তরে পাঁচজনের ছোট্ট দলটা থেকে আরেকজন এয়ারম্যান দড়াম করে আছাড় খেলো ভিজে রানওয়ের ওপর ।
‘ফর গডস সেক, তোমরা আমার সাথে ঠাট্টা করছ নাকি!”
আ্যামুলেন্স যখন পৌছুল, তিনজনের কারও জ্ঞান নেই । গাড়িটার পিছন থেকে স্ট্রেচার নিয়ে দু’জন হাসপাতাল কর্মী নামল, প্রথমে লিটারকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলল তারা । পাঁচজন এয়ারম্যানকে আবার কাজে হাত দেয়ার তাগাদা দিয়ে
অ্যাম্বুলেন্সের সামনের দিকে চলে এল সার্জেন্ট। “এর কোন মানে হয়, বলো? তিক্ত কণ্ঠে ড্রাইভারকে বলল সে। “মহড়ার সময় এক সাথে তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়ল!’
আঙুলের ডগা দিয়ে নাক খুটছিল ড্রাইভার, সার্জেন্টের দিকে ফিরে মাথা নাড়ল সে। ‘এরাই শুধু নয়, সার্জেন্ট, আরও আছে, নাকি সুরে বলল সে। নাক খুটতে খুটতে দূরে তাকাল, চিন্তিত ।
“কি বললে?’
‘লাইনের উল্টো দিকে তিনজন, টাওয়ারে একজন,” বলল ড্রাইভার | “ওহ-হো, ভুলেই গেছি, অফিসার্স কোয়ার্টার থেকেও তিনজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে।’
ভুরু কুঁচকে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে থাকল সার্জেন্ট । দু’দিকের গাল ফুলিয়ে বাতাস ছাড়ল সে, সাথে সাথে বাষ্প হয়ে উড়ে গেল বাতাস । ‘এ-সব কি আজই ঘটেছে? ।
নাক থেকে আঙুল বের করে মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার । “হ্যা । তিন ঘন্টা আগে থেকে শুরু হয়েছে, মাছির মত পটাপট খসে পড়ছে লোকজন । দেখেননি, আ্যাম্বুলেন্সগুলো কেমন ছোটাছুটি করছে!
আ্যামুলেন্সের পিছনের দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, পিছিয়ে এল সার্জেন্ট ।
‘আবার দেখা হবে, সার্জেন্ট, অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিয়ে বলল ড্রাইভার। ‘সাবধানে থাকবেন!’
হাঁ করে থাকিয়ে আছে এয়ারম্যানরা, তাদের দিকে ফিরে সার্জেন্ট বলল, ‘কি শুরু হয়েছে বলো তো?’
সেদিনই পরে একসময় হাসপাতাল বিল্ডিং থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে সয়্যার হেডকোয়ার্টারের দিকে ছুটল একজন ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট । ভেতরে ঢুকে এক এক লাফে তিনটে করে সিড়ির ধাপ টপকাল, তিনতলার করিডরে পৌছে আরও বেড়ে গেল তার গতি | করিডরের শেষ মাথায়, ডান দিকের শেষ দরজায় নক করল সে, কর্নেল বাচ কেলভিন ওয়াকি লেখা নেমপ্লেটের ঠিক নিচে।
‘কাম ইন,” সংক্ষিপ্ত, ভোতা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার ভেতর থেকে ।
নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে ভেতরে ঢুকল লেফটেন্যান্ট । কামরার আরেক প্রান্তে ডেস্কটা, সেদিকে হন হন করে এগোল সে। ডেক্সের পিছনে বসা চৌকো আকৃতির কর্নেলকে স্যালুট করল। কর্নেলের মাথায় খুব ঘন চুল, কাচাপাকা, তবে মাথার শুধু অর্ধেকটা তাতে ঢাকা পড়েছে, সামনের অংশটা কপালের মত তেল চকচকে । .
‘কর্নেল ওয়াকি’, হাপাতে হাপাতে বলল লেফটেন্যান্ট, “স্যার! এইমাত্র হাসপাতাল থেকে এলাম ৷ রোগটা এখনও ছড়াচ্ছে, কোন বেড খালি নেই…
‘কেমন আছে রোগীরা?’ জিজ্ঞেস করল কর্নেল, জুনিয়র অফিসারের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকলেন, উদ্বেগ বা উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করছে না।
“আরও ভয়ঙ্কর সব লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, স্যার! দু’বার বমি করেছি আমি…, ইতস্তত করতে লাগল লেফটেন্যান্ট ।
“বলে যাও” শাত্তভাবে নির্দেশ দিলেন কর্নেল, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন।
“মানে, স্যার, সিমটমণ্ডুলো-সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে.”
“আজ সকালের পাঁচটা কেসের চেয়েও মারাত্মক?
মুখ দিয়ে বাতাস টানল লেফটেন্যান্ট । দ্রুত, ঘন ঘন মাথা ঝাকাল। “অনেক বেশি মারাত্বক, স্যার । জেনারেল বিগবান ঘাবড়ে গেছেন-..’
হিম” মৃদু আওয়াজ করলেন কর্নেল, লেফটেন্যান্টের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সিগারেট ধরালেন অলস ভঙ্গিতে । “ধন্যবাদ, লেফটেন্যান্ট । হাসপাতালে ফিরে গিয়ে জেনারেল বিগবানকে বলো, আমার জরুরী পরামর্শ হলো, এই মুহূর্তে তিনি যেন কন্ডিশন রেড মেডিক্যাল আ্যালার্ট ঘোষণা করেন, গোটা ঘাটি সীল করে দিতে হবে।’
দরজা বন্ধ হতেই ডেক্সের ওপর ঝুঁকে ইন্টারকমের একটা বোতামে চাপ দিলেন কর্নেল ওয়াকি।
‘ইয়েস, স্যার! ব্যগ্র একটা কণ্ঠ ভেসে এল স্পীকার থেকে।
শান্ত, দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন কর্নেল, “ফোনে ওয়াশিংটনের সাথে যোগাযোগ করো । ডিপার্টমেন্ট অভ হেলথ, এডুকেশন, আ্যান্ড ওয়েলফেয়ার। ওদের বলো, ড. পিটার ওয়ান চু-র সাথে কথা বলতে চাই আমি । কোন অজুহাত
শুনবে না।’
সেট অফ করে দিয়ে রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিলেন কর্নেল, পায়ের ধাক্কায় সেটা ঘুরে গেল জানালার দিকে । বাইরে অন্ধকার নামছে । সেদিকে তাকিয়ে থেকে চেয়ারে বসে দোল খেতে লাগলেন তিনি ।
কৃত্রিম হাসি, ঘামে ভেজা করমর্দন, মৌখিক শুভ কামনা, আর কুমীরের কান্না,’ হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং-এর একটা বাথরূমে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে জর্জ বুকান, প্রচণ্ড রাগে কাপছে সে, বিড়বিড় করছে আপনমনে । “সবাই আমার জন্যে সব কিছু করতে তৈরি আছে, কিন্তু চাকরিটা কেন হারালাম কেউ তা বলতে রাজি নয়।’ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়া আইডেনটিটি কার্ড আর পাস, দুটোই ছিড়ে টুকরো টুকরো করল সে, টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিল।
প্যান্টের চেইন তুলল সে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুটিয়ে দেখল নিজেকে। বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু পয়ত্রিশের বেশি মনে হয় না। লম্বাটে, মেদহীন সরু মুখ । মাথা ভর্তি চুল এখনও কাচা । উজ্জ্বল নীল চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত । মুখের রেখা আর
ভাজ দেখে ভান্দাজ করা যায়, মানুষটা বড় একটা হাসে না। আবার বিড়বিড় করল সে, “সত্যি কত দিন আমি হাসি না! আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে তার মনে হলো, এ মুখ ব্যর্থ একজন মানুষের । তারপর সে ভাবল, হায়, প্রথমে
পুরুষত্ব হারালাম, তারপর এই চাকরি-কে আমাকে উদ্ধার করবে! চুল ব্রাশ করার সময় ভেঙ্চাল সে।
দীর্ঘদেহী জর্জ বুকানের মধ্যে পাণ্ডিত্য এবং চিত্তচাঞ্চল্যের দুর্লভ সহাবস্থান লক্ষ্য করার মত। আর্থার ফেলোজ বুকানের একমাত্র সন্তান সে, তিনি একটানা দুই দশক ধরে ক্যাপিটল হিলে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন । বাবার বুদ্ধি এবং প্রাণচাঞ্চল্য .দুটোই পেয়েছে বুকান, তবে বাবার রাজনৈতিক যোগাযোগগুলো একটাও কাজে লাগাতে পারেনি । হোয়াইট হাউসে নিজের চেষ্টায়, কঠোর পরিশ্রম করে ঢুকতে হয়েছে তাকে । বাবা ছিলেন রক্ষণশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী, ছেলে ধরেছে তার ঠিক উল্টো পথ । ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তেরো বছর বয়সেই গ্রেফতার হয় বুকান। সত্তর সালে হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে পাস করে বেরোয়, সেই বছরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কংগ্রেসের নিন্দনীয় ভূমিকার বিরুদ্ধে অনশন ধর্মঘট করে। কনজিউমার মুভমেন্টে নেতৃত্ব দেয় সে, নিগ্রো বেকারদের সংগঠিত করে একটা আন্দোলনের দেয়” পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে । সাতাত্তর সালে বুকান আইন-প্রণেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মার্কিন নাগরিকরা সবাই সমান অধিকার ভোগ করছে না। শাসনতন্ত্রে ক্রটি আছে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে নিয়ে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে মহা হৈ-চৈ পড়ে যায়। কয়েক বছর পর বড় ধরনের একটা তেল কেলেংকারির রহস্য উদঘাটন করে আবার মার্কিন কাগজে আলোচনার বিষয় হয়ে পড়ে সে।
বাবার মৃত্যুর পর কংগ্রেসের খালি আসনটা পাবার জন্যে সব কিছু করে বুকান । কিন্তু ভার্জিনিয়ার ভোটাররা ছেলের চেয়ে বাবার রাজনীতিরই বেশি ভক্ত ছিল। পর পর দু’বার নির্বাচনে হেরে গিয়ে বোধোদয় হলো বুকানের, বুঝল অন্য কোথাও ঠাই নিতে হবে তাকে । ফিরে এল ওয়াশিংটনে, বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে জড়িয়ে পড়ল। অল্প সময়ের মধ্যে হোয়াইট হাউস, সিনেট, আর কংগ্রেসের বাইরে সে-ই হয়ে উঠল সবচেয়ে তুখোড় প্রতিবাদী সমালোচক ।
উনিিশশো পঁচানব্বুই তার ক্যারিয়ারের জন্যে সবচেয়ে গুরুতৃপূর্ণ বছর । সেটা ছিল বর্তমান সংকট দেখা দেয়ার পর দ্বিতীয় বছর। ডানকান ডক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেনশিয়াল অ্যাডভাইজার হবার প্রস্তাব দিলেন তাকে । সম্মানজনক পদ, লোভটা সামলাতে পারল না বুকান। ভাবল প্রেসিডেন্টের কান যদি খালি পাওয়া যায় তাহলে কিছু সৎ পরামর্শ দেয়ার এই সুযোগ ।
ডানকান ডক নর্থ ক্যারোলিনা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ছিলেন। জনপ্রিয় সংস্কারক হিসেবে তার খ্যাতি আকাশচুম্বি হয়ে ওঠে। তার প্রিয় স্লোগান, যুক্তরাষ্ট্র বাচলে দুনিয়া বাচবে। অত্যন্ত ধর্মভীরু প্রকৃতির মানুষ তিনি,
কোন অন্যায় কাজ তাকে দিয়ে করানো সম্ভব বলে মনে হয় না। দুনিয়া জোড়া দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার শুরুতে তিনি ঘোষণা করেন, প্রয়োজনে আমেরিকানরা একবেলা খাবে, তবু তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষকেও না খেতে পেয়ে মরতে
দেয়া হবেনা।
হোয়াইট হাউসে ডুকল জর্জ বুকান, সেই সাথে তার অস্বস্তিতে ভোগাও শুরু হলো । প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা সে একা নয়, আরও অনেক আছে। তারা বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, বেশিরভাগই কট্টর রক্ষণশীল, বর্তমান সংকট থেকে শুধু আমেরিকাকে বাঁচানোর ব্যাপারে আগ্রহী । গোটা দুনিয়া রসাতলে গেলেও তাদের কিছু আসে যায় না। দিনে দিনে বুকান উপলব্ধি করল, গোটা আমেরিকাকেও নয়, তাদের কেউ কেউ শুধু ভাগ্যবান পুঁজিপতি আমেরিকানদের স্বার্থ রক্ষা করছে। তবু সে হাল ছাড়ল না, আশায় আশায় থাকল প্রেসিডেন্টকে কিছু সৎ পরামর্শ দিতে পারা যাবে। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সভ্যতা, এখনই তো সময় ভাল মানুষদের একত্রিত হয়ে কিছু একটা করার ।
প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েছেন দেড় বছর হলো, এতদিনে বুকান বুঝতে পারলতার পরামর্শ তেমন গ্রাহ্য করে না হোয়াইট হাউস। উপদেষ্টা, মন্ত্রী, এবং কর্মকর্তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি লেগেই আছে। হোয়াইট হাউসে গ্রুপ পলিটিক্সের ‘জয়জয়কার। কিন্তু তার গ্রর্পে সে শুধু একা । তার শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা কম নয়, কিন্তু তারাও নিজেদের নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। তৃতীয় বছরের প্রথম দিকে তার শক্ররা তাকে প্রেসিডেন্টের ইনার সার্কেল থেকে কৌশলে বের করে দিল। গালভরা পদটা শুধু নামে মাত্র থাকল, একান্ত গোপনীয় সিদ্ধান্তগুলে! যখন নেয়া হয় প্রেসিডেন্টের পাশে তখন তাকে দেখা যায় না। শক্ররা তার দুর্বলতা জেনে ফেলেছে, পুজিপতিরা কেউ তার সমর্থক নয়, এরপর প্রকাশ্যে তার সমালোচনা শুরু হলো । শুভানুধ্যায়ীরা পর্যন্ত চোখ উল্টে নিল, চেষ্টা করতে লাগল হোয়াইট হাউস থেকে কিভাবে তাকে সরানো যায়। সেই থেকে হাসতে ভুলে গেল জর্জ বুকান। এবং পুরুষত্ব হারাল।
বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল সে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে হোয়াইট হাউসে তার শেষ কর্মটি এখনই সম্পন্ন করবে। মদ খেয়ে মাতাল হবে, কিন্তু কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না।
‘এই যে, এতক্ষণে পাওয়া গেল তোমাকে, তাকে পার্টিতে ফিরে আসতে দেখে কেউ একজন দরাজ গলায় বলল । হাসছে, যেন বরফের মুখোশ পরা একটা মুখ। লোকটা আয়ান ক্যামেরন, তার বন্ধু, এবং প্রেসিডেনশিয়াল উপদেষ্টা ও
মন্ত্রীসভার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি।
‘হাই, আয়ান,’ ভঙ্গুর হেসে বলল জর্জ বুকান। ‘নিন্দিত লোকটার সাথে দু’ঢোক খাবে নাকি?”
‘খুব খারাপ,” আয়ান ক্যামেরর কঠিন সুরে বলল। “কোন রকম আত্মসমালোচনা নয়, মনে আছে? তুমিই না সব সময় কথাটা মনে করিয়ে দাও আমাকে?”
ম্রিয়মান চেহারা নিয়ে দুটো গ্রাসে হুইস্কি ভরল বুকান, ক্যামেরনের গ্রাসে এক আউন্স, নিজেরটায় দু’আউন্সেরও বেশি । ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মাথা নাড়ল ক্যামেরন, ফিসফিস করে বলল, “নিয়ন্ত্রণ হারিয়ো না, প্রিজ ।’
বিষণ্ণ চোখ মেলে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে জিগ্যেস করল বুকান, “কিন্তু কেন. আয়ান? কেন?’ আয়ান কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে বাধা দিল সে, “এখন আর অবশ্য কিছু আসে যায় না।’ ঢকঢক করে হুইস্কিটুকু একবারে খেয়ে ফেলল সে।
আরও কাছে সরে এসে ধরার জন্যে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল আয়ান ক্যামেরন । ‘আমরা কয়েকজন এখনও ব্যাপারটাকে গুরুতৃ দিই, কোমল স্বরে বলল সে। ‘তুমি যা চাও, আমরা কয়েকজনও ঠিক তাই চাই । তুমি তা জানো,
জর্জ ।’
বন্ধুর সাথে হ্যান্ডশেক করল জর্জ বুকান। ‘হ্যা, আমি জানি, গম্ভীর সুরে বলল সে, আয়ান ক্যামেরবের হাসির উত্তরে সেও মৃদু হাসল? তারপর হঠাৎ অপ্রতিভ ভঙ্গিতে, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার হুইস্কি ঢালল গ্লাসে ।
‘এমন তো ‘নয় যে প্রেসিডেন্ট আমাদের কথা শোনেন না, জর্জ। ভেবো না সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।’
‘আশা করি তা যায়নি । কিন্তু দুনিয়ার চেহারাটা দেখছ তো, শেষ রক্ষা করতে হলে আর দেরি করা চলে না। দুনিয়ার ষাটভাগ রিসোর্স আমরা একা ভোগ করব, এটা কোন হতে পারে না। নয়শো কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার তাদের দিকে পিছন ফিরে থাকা মানবিকতা নয়।’
“কিন্তু প্রেসিডেন্ট তো বলেছেন দরকার হলে আমেরিকানরা এক বেলা খাবে…
‘মার্কিন গমবাহী জাহাজ মাঝ সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে, সে খবর রাখো তুমি? চাপা, কিন্তু তীব্র ঝাঝের সাথে প্রশ্ন করল জর্জ বুকান। “আমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা চাইছে এই সুযোগে গরীব দেশগুলোর কয়েকশো কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যাক, অস্বীকার করতে পারো?
‘তেমন যদি কেউ থাকে, তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমরা তাকে অবশ্যই কোণঠাসা করব। হ্যা, চারদিকে অবস্থা খুবই খারাপ। কাল মে ব্রিট কি বলল জানো? মে ব্রিট, ওয়ার্ল্ড হেলথে ছিল-বলল, বোম্বে শহর কুকুরশূন্য হয়ে পড়েছে।
কুকুর দেখলেই মেরে খেয়ে ফেলছে মানুষ ।’
শুধু কুকুর? চীনে তো শুনছি মানুষ মানুষকে খাচ্ছে! তাই বলছিলাম… বিবেকের দংশন অনুভব করে হঠাৎ থেমে গেল জর্জ বুকান। এই দ্বন্দ্বটা তার চরিত্রে থেকেই গেল-জর্জ বুকান, নির্যাতিত জনতার শুভানুধ্যায়ী, গরীব মানুষের
কণ্ঠস্বর, নিজে একজন ধনী মানুষ। দুনিয়ার বেশিরভাগ মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সম্পদের সুষম বন্টন সম্ভব হয়নি বলে, কার্ল মার্কসের মত কথাটা জর্জ বুকানেরও জানা আছে। মার্কস অবশ্য অভাবের মুখ দেখেছেন, জর্জ বুকানের জানা নেই সত্যিকার অভাব কাকে বলে।
“মি, বুকান, মি. বুকান!’ জর্জ বুকানের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হলো যুবক এক সেক্রেটারি । ‘আপনার ফোন, স্যার। ইচ্ছে হলে পাশের কামরায় গিয়ে ধরতে পারেন, মি. বুকান।’
‘আশপাশে থেকো, আয়ান, বলে পাশের কামরার দিকে পা বাড়াল জর্জ বুকান।
‘বুকান বলছি,” রিসিভার তুলে জানাল সে। মনটা তার খুশি হয়ে উঠল, ফোন করেছে জক বালডামাস। সাত বছর আগে বুকান যখন মিনোমিনী ট্রাইবের নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে, জক বালডামাস তখন ইন্ডিয়ান
আ্যাফেয়ার্স-এর ডিরেক্টর ছিল। মিশিগানের আপার পেনিনসুলায় হাজার বছর ধরে বসবাস করছিল মিনোমিনীরা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার নোটিস দেয়। ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, বন্দুকের নলের মুখে বাধা দিয়ে দু’জন ফেডারেল এজেন্টকে জিম্মি রাখে তারা । বুড়ো হেনরি কেনার্ডকে সাথে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল জর্জ বুকান ।
বুকানের সন্দেহ হয়, সরকারের সাথে জেনারেল মাইনিং করপোরেশন গোপন চুক্তি করেছে, তাদের প্ররোচনাতেই আদিবাসীদের উচ্ছেদ করতে চাইছে সরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইন্ডিয়ান আ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর ‘জক বালডামাসের সাথে ‘দেখা করে বুকান, বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করে এই লোককে কেনা স্ম্ভব নয়। ইন্ডিয়ানদের পক্ষে একসাথে কাজ করে ওরা, শেষ পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্ট আদিবাসীদের অনুকূলে রায় দেয়। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে;
আজ জক বালডামাস সেক্রেটারি অভ ইন্টেরিয়র ।
‘জক, আছ কেমন হে? সহাস্যে জিজ্ঞেস করল বুকান।
‘আমি ভাল, জর্জ, খুব ভাল। এই মাত্র শুনলাম তুমি রিটায়ার করেছ। ভাবলাম শুভেচ্ছা জানাই । ওরা তোমাকে ঠেলে সরিয়ে দিল নাকি?”
“সরতে আমাকে হতই, জক, দু’দিন আগে বা পরে, ম্লান কণ্ঠে বলল জর্জ বুকান। ‘খবরের কাগজে আগেই জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছিল, দেখোনি? উদারপন্থীদের বাদ দেয়া হবে। তাছাড়া, রাজনৈতিক কোন্দলে যারা অংশ নিতে পারে না তারা তো কোণঠাসা হবেই ।’
যা, সবই বুঝি তা কি করবে কিছু ভেবেছঃ আবার কনসালচিং ফার্ম খুলবে নাকি?
‘পারব না। কেন, তুমি শোনোনি? কারও বয়স পঞ্চাশ হলে সে আর নতুন করে কোন ব্যবসায় হাত দিতে পারবে না। এধরনের একটা আইন পাস করতে যাচ্ছে কংগ্রেস । ভেবে দেখো ইদানীং কে পঞ্চাশে পা দিল ।’
“এ অসম্ভব! কি ভেবেছে কি ওরা!
“বাদ দাও। সময় হলে চ্যালেঞ্জ করার লোক বেরিয়ে পড়বে । তোমার কি খবর তাই বলো ।’
“নির্ভর করছে ডানকান ডক নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারে কিনা তার ওপর, বলল জক বারডামাস। প্রতিপক্ষ আমাকে রাখবে না । প্রেসিডেন্ট জিতলে আরও ছ’বছরের জন্যে থেকে যাব।” দুনিয়া জোড়া সংকট দেখা দিয়েছে, এই………
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।