একটু চোখ বুলিয়ে নিন
প্রথম পরিচ্ছেদ
সেকালে হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে হেডমাস্টারবাবু বিদ্যালয়ের রত্ব বলিয়া যে তিনটি ছেলেকে নির্দেশ করিতেন, তাহারা তিনখানি বিভিন্ন গ্রাম হইতে প্রত্যহ এক ক্রোশ
পথ হাটিয়া পড়িতে আসিত। তিনজনের কি ভালবাসাই ছিল! এমন দিন ছিল না যেদিন এই তিনটি বন্ধুতে স্কুলের পথে ন্যাড়া বটতলায় একত্র না হইয়া
বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিত! তিনজনেরই বাড়ি ছিল হুগলির পশ্চিমে । জগদীশ আসিত সরস্বতীর পুল পার হইয়া দিঘৃড়া গ্রাম হইতে, এবং বনমালী ও রাসবিহারী
আসিত দুইখানি পাশাপাশি গ্রাম কৃষ্ণপুর ও রাধাপুর হইতে । জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবেচেয়ে মন্দ। পিতা একজন ব্রান্মণ-
পপ্তিত। যজমানি করিয়া বিয়া-পৈতা দিয়াই সংসার চালাইতেন। বনমালীরা সঙ্গতিপন্ন জমিদার | তাহার পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়াই জানিত, অথচ
পল্লীগ্রামের সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন । রাসবিহারীদের অবস্থাও বেশ সচ্ছল । জমিজমা চাষবাস পুকুর-বাগান-পাড়ারীয়ে যাহা থাকিলে সংসার চলিয়া যায়, সবই ছিল। এ-সকল থাকা সত্ত্বেও যে ছেলেরা কোন শহরে বাসাভাড়া না করিয়াঝড় নাই, জল নাই, শীত-্্রীম্ম মাথায় পাতিয়া এতটা পথ হাঁটিয়া
প্রত্যহ বাটা হইতে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করিত, তাহার কারণ, তখনকার দিনে কোন পিতামাতাই ছেলেদের এই ক্লেশ-স্বীকার করাটাকে ক্লেশ বলিয়াই ভাবিতে
পারিতেন না; বরঞ্চ মনে করিতেন, এতটুকু দুঃখ না করিলে সরস্বতী ধরা দিবেন না। তা কারণ যাই হোক; এমনি করিয়াই ছেলে-তিনটি এন্ট্রান্স পাশ
করিয়াছিল । বটতলায় বসিয়া ন্যাড়া বটকে সাক্ষী করিয়া তিন বন্ধুতে প্রতিদিন এই প্রতিজ্ঞা করিত-_জীবনে কখনও তাহারা পৃথক হইবে না, কখনও বিবাহ
করিবে না, এবং উকিল হইয়া তিনজনেই একটা বাড়িতে থাকিবে; টাকা রোজগার করিয়া সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে জমা করিবে, এবং তাই দিয়া দেশের কাজ
করিবে ।
এই ত গেল ছেলেবেলার কল্পনা । কিন্তু যেটা কল্পনা নয়, সত্য, সেটা অবশেষে কিরূপ দাড়াইল, তাহাই বলিতেছি। বন্ধত্রে প্রথম পাকটা এলাইয়া গেল বি.
এ. ক্লাসে । কলিকাতায় কেশব সেনের তখন প্রচণ্ড প্রতাপ। বক্তৃতার বড় জোর। সে জোর পাড়াীয়ের ছেলে-তিনটি হঠাৎ-সামলাইতে পারিল না-ভাসিয়া গেল । গেল বটে, কিন্তু বনমালী এবং রাসবিহারী যেরূপ প্রকাশ্যে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ব্রাক্মসমাজভুক্ত হইল, জগদীশ সেরূপ পারিল না-ইতস্ততঃ করিতে
লাগিল । সে সর্বাপেক্ষা মেধাবী বটে, কিন্তু অত্যন্ত দুর্বলচিত্ত। তাহাতে তাহার ব্রাক্মণ-পপ্তিত পিতা তখনও জীবিত ছিলেন । কিন্তু ও-দুটির সে বালাই ছিল না।
কিছুকাল পূর্বে পিতার পরলোকপ্রাপ্তিতে বনমালী তখন কৃষ্ণপুরের জমিদার, এবং রাসবিহারী তাহাদের রাধাপুরের সমস্ত বিষয়-আশয়ের একচ্ছত্র সম্রাট । অতএব
অনতিকাল পরেই এই দুই বন্ধু ব্রাহ্ম-পরিবারে বিবাহ করিয়া বিদুধী ভার্ধা লইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু দরিদ্র জগদীশের সে সুবিধা হইল না। তাহাকে
যথাসময়ে আইন পাশ করিতে হইল, এবং এক গৃহস্থ ব্রাক্মণের এগারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করিয়া অর্থোপার্জনের নিমিত্ত এলাহাবাদে চলিয়া যাইতে হইল ।
কিন্তু যাহারা রহিলেন, তাহাদের যে কাজ কলিকাতায় নিতান্ত সহজ মনে হইয়াছিল, গ্রামে ফিরিয়া তাহাই একান্ত কঠিন ঠেকিল। বৌ-মানুষ শ্বশুরবাড়ি আসিয়া
ঘোমটা দেয় না, জুতামোজা পরিয়া রাস্তায় বাহির হয়__তামাশা দেখিতে পাচখানা গ্রামের লোক ভিড় করিয়া আসিতে লাগিল; এবং গ্রাম জুড়িয়া এমনি একটা