Oronno by Humayun Ahmed

অরণ্য – হুমায়ূন আহমেদ (Oronno by Humayun Ahmed)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

মশারির ভেতর একটা মশা ঢুকে গেছে।

পাতলা ছিপছিপে বুদ্ধিমান একটা মশা । কোথাও বসলেই তাকে মরতে হবে এটি
জানে বলেই কোথাও বসছে না। ক্রমাগত উড়ছে।

সোবাহান তীক্ষুদৃষ্টিতে তাকাল। নিশ্চয়ই একসময় সে বসবে। কিন্তু বসছে না,
অসন্ভব জীবনীশক্তি । সোবাহানের মাথায় আজগুবি ভাবনা আসতে লাগল-_এই মশাটির
বয়স কত ? এ কি বিবাহিত ? এর ছেলেমেয়ে আছে কি ? ওদের একা ফেলে সে মরবার
জন্যে মশারির ভেতর ঢুকল ? মৃত্যুর পর ওর আত্মীয়স্বজন কাদবে কি ? নাকি প্রেম
ভালোবাসা এসব শুধু মানুষের জন্যেই ? বোধহয় না। একবার সোবাহানের ছোটচাচা
একটা কাক মেরে গাবগাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল । ঘণ্টাখানিকের মধ্যে কাকটির মৃত্যুসংবাদ
প্রচারিত হয়ে গেল। হাজার হাজার কাক বাড়ির চারপাশে কা কা করতে লাগল । ভয়াবহ
ব্যাপার ।

এই মশাটির মৃত্যুসংবাদও কি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে ? অযুত নিযুত মশা পিন
পিন শব্দে উড়ে আসবে ? খুব সম্ভব না। নিচুস্তরের কীটপতঙ্গের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা
নেই, আর থাকলেও তাতে মৃত্যুর কোনো ভূমিকা নেই।

একসময় মশাটি মশারির এক কোনায় স্থির হয়ে বসল । তার গায়ের রঙ হালকা
নীল। পাখার নিচের দিকটা চকচকে খয়েরি । মশারা এমন বাহারি হয় তা সোবাহানের
জানা ছিল না। সোবাহান মনে মনে বলল, তুমি মরতে যাচ্ছ। মরবার আগে তোমার কি
কিছু বলার আছে?

মশাটি পাখা নাড়ল। মনের কথা বুঝতে পারে নাকি ? টেলিপ্যাথি ? “নিশ্নশ্রেণীর
কীটপতঙ্গরা ভাবের আদানপ্রদান টেলিপ্যাথির মাধ্যমে করিয়া থাকে ।’ কোথায় যেন
পড়েছিল কথাটা । সাপ্তাহিক কাগজেই বোধহয় । সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে অদ্ভুত সব খবর
ছাপা হয়। একবার এক কাগজে ধর্মপ্রাণ একটা খেজুরগাছের ছবি ছাপা হলো। এই
গাছটা নাকি নামাজের সময় হলেই পশ্চিমদিকে হেলে সেজদা দেয়। গাছগাছালির
মধ্যেও ধর্ম প্রচারিত হচ্ছে? ইসলাম ধর্মের অনুসারী এই গাছটি খুব দেখার ইচ্ছা ছিল।
কিন্তু মানুষের অধিকাংশ ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে ।

মশাটি সম্ভবত স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়েছে। একটুও নড়ছে না। সোবাহানকে
দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে দেখে তার ছাইবর্ণের একটি পাখা শুধু কাপল।
নিন্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গরা মানুষকে কীভাবে গ্রহণ করে এটি কোনোদিন জানা হবে না।
ঈষৎ অন্যমনস্কতার পর মশাটিকে সোবাহান দু’হাতে পিষে ফেলল ।

পিন পিন শব্দ হচ্ছে নাকি ? অযুত নিযুত মশা কি উড়ে আসছে? যাদের রঙ নীলাভ,
পাখার নিচটায় নরম খয়েরি রঙ ।

লেখক সম্পর্কে

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ‘নন্দিত নরকে’র মাধ্যমে আত্নপ্রকাশ। এই উপন্যাসে নিম্নমধ্যবিত্ত এক পরিবারের যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন, মর্মান্তিক ট্রাজেডি মূর্ত হয়ে উঠেছে। নগর জীবনের পটভূমিতেই তার অধিকাংশ উপন্যাস রচিত। তবে গ্রামীণ জীবনের চিত্রও গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন এই কথাশিল্পী। এর উজ্জ্বল উদাহারণ ‘অচিনপুর’, ‘ফেরা’, মধ্যাহ্ন। মুক্তিযুদ্ধ বারবার তার লেখায় ফুঠে উটেছে। এই কথার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘১৯৭১’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নির্বাসন’ প্রভৃতি উপন্যাস। ‘গৌরিপুর জংশন’, ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’ -এ জীবন ও চারপাশকে দেখার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘বাদশা নামদার’, ‘মাতাল হাওয়া’য় অতীত ও নিকট-অতীতের রাজরাজরা ও সাধারণ মানুষের গল্প ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top