একটু চোখ বুলিয়ে নিন…
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কুল জোড়া জল, বুক ভরা ঢেউ। প্রান ভরা উচ্ছ্বাস । স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়: রাতের চাদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই । আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই । তিতাস মাঝারি নদী । দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সীতরাইয়া পার হইতে পারে না।আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
তিতাস শাহী মেজাজে চলে । তার স্ব মত বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলভা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার্টি্র খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুর্পক্ষের জোয়ারের উদ্টর্তত্তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্ধেল করে না।
কত নদীর তীরে একদা কট ব্যাপারীদের কুঠি-কেন্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁ্জিয়া পাওয়া যায় । কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাবু পড়িয়া আছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে_ উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সে সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে । আজ হয়ত তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্ত্র পুথির পাতায় রেখ্ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই । সে শুধু একটা নদী।
তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না । ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই। ঝরণা থেকে জল টানিয়া পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনকালে সে পায় নাই । অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোনকালে কোন অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল: বা তীরটা একটু মচকাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি ধুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে ।
লেখক সম্পর্কে
অদ্বৈত মল্লবর্মণ একটিমাত্র সাহিত্যকৃতির সূত্রেই তার আপন ভাষাগোষ্ঠীর কাছে শ্রদ্ধেয় শুধুমাত্র নন, অবশ্যপাঠ্যও বটে। তিতাস একটি নদীর নাম বাংলাভাষার পাঠকের সংসারে প্রায় তিন পুরুষ ধরে পঠিত। অদ্বৈতর জীবনাখ্যান আর তিতাস – একে অপরের সঙ্গে নিগুঢ় বন্ধনে আবদ্ধ । এসবসত্তেও তিনি দীর্ঘকাল আমাদের কাছে অপরিচিতই থেকে গেছেন, তিতাসের মধ্যে যতটুকু আভাস জগৎ। স্পষ্ট কোনো ছবি ছিল না মানুষটির । আত্মপ্রচারের সম্পূর্ণ বিপরীতে আত্মনিমগ্র এক “কর্মশিল্পীর নিদারুণ সত্যের পথে পরিক্রমার আখ্যান ছিল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । তিতাস একটি নদীর নাম তার স্মরণীয় উপন্যাস। প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমশ মুছে আসা মৎসজীবী যে মানুষদের কাহিনী এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে অদ্বৈত সেই মালো সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন।