ব্ল্যাক ম্যাজিক – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Black Magic – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

এক

২৩ মে, ১৯৪৫।

সোফার এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে, যেন মানুষ নয়, একটা কঙ্কাল। কন্বলে জড়ানো হাড়সর্বস্ব কাঠামোটা থরথর করে কাপছে। লোকটার করুণ অবস্থা দেখে সহানুভূতির ক্ষীণ হাসি ফুটতে যাচ্ছিল সার্জেন্ট-মেজর মারফি গুডউইনের ঠোটে । ফুটল না, কারণ তার মনে পড়ে গেল, লোকে বলাবলি করছে সম্ভবত নিরীহদর্শন এই লোকটিই কয়েক মিলিয়ন মানুষকে হাসতে হাসতে খুন করেছে সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের সময়। ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষ ও নৃশংসতা দুনিয়ার মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। নিজের দেশ শুধু জার্মানিতে নয়, দখল করা অন্যান্য দেশেও ইহুদিদের যম হয়ে উঠেছিল লোকটা । যুদ্ধ থেমে গেছে, তবে এখনও প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে; সেসব অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনে বিস্ময় ও ঘৃণায় অবশ হয়ে যাচ্ছে মানুষ । সত্যিই কি এই লোকটাই সেই পিশাচ? দেখে মনে হয় ভীতুর ডিম,চেহেরায় গোবেচারা ভাব, সামরিক কম্বলের নিচে শুধু শার্ট ও প্যান্ট পরে আছে। নাকি নিজের যে পরিচয়টা দিচ্ছে সেটাই সত্যি? সেই পরিচিত গোঁফ জোড়া নেই, চুল-দাঁড়ি না কাটায় ঢাকা পড়ে আছে দুর্বল চিবুক ও ঘাড়, পরনে নেই সামরিক ইউনিফর্ম, চেহেরায় জেদ ও কর্তৃত্বের ভাব সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। গ্রেফতারের সময় জার্মান লোকটার চোখে কালো পট্টি বাধা ছিল, ইউনিফর্মে কোনও প্রতীক চিহ্ বা ব্যাজ ছিল না। নিজেকে সিক্রেট ফিল্ড পুলিসের একজন সদস্য বলে জানায় সে, তবে জেরা
করায় বেরিয়ে আসে মিথ্যে কথা বলছে। ইন্টারোগেটরদের সন্দেহ বাড়ে।

চোখ থেকে টেনে খুলে ফেলা হয় কালো পট্টি । পরানো হয় একখানা রিমলেস চশমা হাবভাব সন্ত্রস্ত হলেও, সেই কুখ্যাত খুনীর সাথে তার চেহারার মিল ফুটে ওঠে পরিষ্কার ।


তবে কর্ণেল ডানকান, ইন্টেলিজেন্স চীফ, নিজের পরিচয় সম্পর্কে জার্মান লোকটার পরিচয় মেনে নিয়েছেন বলে মনে হয়। কাজেই সে, নগন্য একজন সার্জেন্ট-মেজর, কেন শুধু শুধু সন্দেহে ভুগবে? তার উপর নির্দেশ আছে, সারাটা দিন যেন কড়া নজর রাখা হয় বন্দীর ওপর । তারমানে, বন্দীকে খুব গুরুতু দেয়া হচ্ছে। এর আগে ও বন্দী খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় সার্জেন্ট-মেজর, তাকে ফাকি দিয়ে আত্মহত্যা করে এস এস জেনারেল প্রুয়েজমান। মুখের ভেতর সায়ানাইড ক্যাপসুল ছিল, দাত দিয়ে ভেঙে ফেলে সেটা । তবে এই লোকটাকে, তার পরিচয় যাই হোক, কোনও সুযোগ দেবে না সে।

দোভাষীর সাহায্যে বন্দীকে জানাল সাজেন্ট, সোফাটাই তার বিছানা, শোয়ার আগে কাপড়চোপড় খুলে ফেলতে হবে তাকে ৷ প্রতিবাদ জানাল বন্দী, তবে ইংরেজ সার্জেন্টের চেহারায় কাঠিন্য লক্ষ করে আবার চুপ করে গেল । কাঁধ থেকে কন্বলটা নামিয়ে কাপড় খুলতে শুরু করল সে।

এই সময় কামরায় ঢুকলেন কর্নেল ডানকান, সাথে একজন ইউনিফর্ম পরা অফিসার। ইন্টেলিজেন্স চীফ অফিসারের পরিচয় দিলেন-ক্যাপ্টেন রবিন, সেনাবাহিনীর ডাক্তার ৷ তারপর তিনি বন্দীকে সম্পূর্ণ বিবন্ত্র হবার নির্দেশ দিলেন ।

কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারল সার্জেন্ট । দু’দিন আগে বন্দীর জ্যাকেটের সেলাই করা ভাঁজের ভেতর একটা ক্যাপসুল পাওয়া গেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, লোকটার কাছে আরও ক্যাপসুল থাকতে পারে । কর্নেল কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

বন্দীর দেহ তল্লাশি শুরু হল। প্রথমে আঙুল চালান হল মাথার চুল দাড়িতে। তারপর নাভির নিচে, যেখানে দুই উরু এক হয়েছে। বন্দীকে উপুড় করা হল, দু’দিক থেকে টেনে ধরা হল নিতম্ব, চেক করা হল পায়ুপথ । কানের ফুটো, দুই
আঙুলের মধ্যবতী ফাক, বগলের তলা, কিছুই বাদ দেয়া হল না। বাকি থাকল শুধু মুখের ভেতরটা । বন্দীকে হা করার নির্দেশ দিল ডাক্তার ।

ছোট্ট ও কালো ক্যাপসুলটা সাথে সাথে দেখতে পেল ক্যাপ্টেন রবিন। ডান দিকে, নিচের সারির দাতের ফাকে আটকে রয়েছে। চিৎকার করল ডাক্তার, ঝট করে মুখের ভেতর কয়েকটা আঙুল ঢুকিয়ে দিল। জার্মান বন্দী মাথাটা দ্রুত একপাশে সরিয়ে নিয়ে কামড় বসাল ডাক্তারের আঙুলে । বন্দীকে লক্ষ্য করে একযোগে লাফ দিল কর্নেল ডানকান ও সার্জেন্ট-মেজর হাডসন, অস্থির বন্দীকে পেড়ে ফেলল মেঝেতে । বন্দীর গলাটা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরল ডাক্তার, বন্দী যাতে মুখ থেকে ক্যাপসুলটা বের করতে বাধ্য হয়। তবে এরইমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, দাতের চাপে আগেই ভেঙে গেছে সেটা, শুরু হয়ে গেছে বিষক্রিয়া । মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ঠেকাবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করল ওরা । সার্জেন্টকে যত তাড়া সম্ভব সুতো আর সুই আনার নির্দেশ দিলেন কর্নেল । তুচ্ছ-এই জিনিস দুটোর খোজে গোটা ইন্টারোগেশন সেন্টার প্রায় চষে ফেলল সার্জেন্ট । এদিকে বন্দীর গলা এখনও চেপে ধরে আছে ডাক্তার । তবে এরইমধ্যে খিচুনি শুরু হয়ে গেছে বন্দীর শরীরে । খানিক পরই ফিরে এল সার্জেন্ট । ইন্টেলিজেন্স চীফের হাত
কাপছে না, তিনিই সুইয়ে সুতো পরালেন। বন্দীর মুখটা হাতের চাপ দিয়ে খুলে রাখল সাজেন্ট,পিচ্ছিল জিভটা এক হাতে ধরলেন কর্ণেল, অপর হাতে জিভের গায়ে ঢুকিয়ে দিলেন সুই । সুতোয় টান দিয়ে জিভটাকে বাইরে আনা হল, ওটা যাতে গলায় আটকে না যায়। পনেরো মিনিট ধরে স্টমাক-পাম্প করা হল। প্রচলিত সমস্ত পদ্ধতিতে বন্দীর শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলল । কোনও লাভ হল না। সায়ানাইডের বৈশিষ্ট্যই হল তাৎক্ষণিক মৃত্যু ডেকে আনে, ওদের তিনজনের সম্মিলিত চেষ্টায় মৃত্যু বিলম্বিত হল মাত্র। শেষ একটা খিঁচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল বন্দীর শরীর, অসহ্য যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে থাকল মুখের চেহারা ।

দু’দিন পর সার্জেন্ট-মেজর হাডসন সামরিক কম্বল দিয়ে লাশটা মুড়ল, তারপর টেলিফোনের তার দিয়ে বাধল ভাল করে। লুনেবুর্গ- এর কাছাকাছি অখ্যাত এক কবরস্থানে চাপা দেয়া হল লাশটাকে | রাইখসফুয়েরার এসএস হেনেরিক
হিমলারের শেষ পরিণতি সম্পর্কে কোথাও কোনও রেকর্ড রাখা হল না।

দুই

সুটকেসটা মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে বিছানার ওপর আছড়ে পড়ল মাসুদ রানা । প্রায় আঠারো ঘন্টা একটানা গাড়ি চালিয়ে সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও, আড়ষ্ট পেশীগুলোয় যেন কোনও সাড়া নেই । আসলে আজ, রোববার রাত দশটার মধ্যে লগুনে পৌছতে চেয়েছিল ও, ভাল একটা ঘুম দিয়ে কাল সকালে যাতে রানা এজেন্সির যেতে পারে। লিভারপুল থেকে রওনা হয়েছিল ঠিক সময়েই, পৌছুতে মাত্র এক ঘন্টা বেশি সময় লেগেছে, তবে শরীরের বারোটা বেজে গেছে।
তবু শান্তি বোধ করছে, খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ শেষ, কাল থেকে রানা এজেন্সির লিভারপুল শাখা পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারবে । ওদিকে বার্মিংহাম ও প্লাইমাউথ শাখাও গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। তিন মাসের কাজ তিন হপ্তার ভেতর শেষ করার মধ্যে একটা গর্ব আছে, ব্রিটিশ সরকারও ওদের দক্ষতার প্রশংসা না করে পারবে না। আর মাত্র দুই কি তিন দিন লন্ডন শাখায় অফিস করবে রানা, তারপর ফিরে যাবে হেডকোয়ার্টার ঢাকায় ।

দশ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার পর নরম বিছানায় শোল্ডার ব্লেড দুটো ঘষল রানা, হাত না লাগিয়ে খুলে ফেলল ‘জুতো জোড়া । আবার স্থির হয়ে গেল শরীর । একবার ভাবল, তমাকে ফোন করে জানালে হয় ফিরে এসেছে ও । মাথা তুলে হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল। চিন্তাটা বাতিল করে দিল সাথে সাথে, রাত সোয়া এগারোটায় ওকে বিরক্ত করা উচিত হবে না। গত হপ্তায় দু’তিন বার তমার সাথে যোগাযোগ হয়েছে ফোনে, লন্ডন শাখায় সব ঠিকঠাক আছে বলেই জানান হয়েছে ওকে । কাজ-কর্মের খবর কাল সকালে অফিসে গিয়ে জানলেই হবে।

হাত-পা টান টান করে আড়মোড়া ভাঙল রানা, ঘুমে তলিয়ে যাবার ঝোকটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, সারা রাত খালি পেটে থাকাটা ঠিক হবে না। টনিক সহযোগে, এক, কি বড় জোর দু’ঢোক ভোদকা এখন জাদুর মত কাজ করবে ওর মেটাবলিজমে ।

একটা গড়ান দিয়ে বিছানা ছাড়ল রানা, ক্লান্ত পায়ে জানালার দিকে এগোল। নিচেটা অন্ধকার, রাস্তার উল্টোদিকের চার্চের উঠনটা পরিষ্কার দেখা গেল না-শার্সির গায়ে ওর নিজের গাঢ় প্রতিবিস্ব নিচের দৃশ্যটাকে ঝাপসা করে রেখেছে।

কিংসব্রিজের কাছাকাছি প্রায় নির্জন এলাকায় ছোট্ট এই বাড়িটা মাস ছয়েক হল ভাড়া করা হয়েছে, লন্ডনে এলে এখানেই থাকে রানা । সরু, ছোট্ট একটা গলির শেষ মাথায় বাড়িটা, শহুরে কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে । রাস্তার ওপারে চার্চটাকে ঘিরে আছে খুদে একটা পার্ক, ছুটির দিন খবরের কাগজ নিয়ে বারান্দায় বসলে সময়টা বড় শান্তির সাথে কাটানো যায় । পার্কের ভেতর পাথর দিয়ে বাধানো বেশ কয়েকটা কবর আছে, বহুকালের পুরানো, নিরাপদ পরিবেশটাকে আরও যেন শান্ত ও স্থিতিশীল করে তুলেছে। পার্কের ভেতর ছড়ান-ছিটান বেঞ্চগুলো প্রতিবেশীরা যেন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে, এমনকি তাদের কুকুরগুলোও প্রত্যেকে নির্দিষ্ট এক-একটা গাছের গায়ে ঠ্যাং তুলে প্রস্রাব করে।

পর্দা টেনে নিজের গাঢ় প্রতিবিম্ব ঢেকে দিল রানা। মোজা না খুলেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে, কার্পেট থেকে কোনও শব্দ উঠল না। ছোট্ট হলওয়ে পেরিয়ে কিচেনে এসে ঢুকল ও। এক আউন্স ভোদকার সাথে খানিকটা টনিক মিশিয়ে চুমুক দিল গ্লাসে । সিদ্ধান্ত নিল, এত রাতে আর রেস্তোরায় যাবে না। ফ্রিজ খুলে স্যান্ডউইচ বের কল! ওর ক্লিনিং লেডি , হপ্তায় দু’বার আসে, রানার অনুপস্থিতিত নিয়মিত বাসি খাবার ফেলে তাজা খাবার ভরে রেখে যায় ফ্রিজে ।

স্যান্ডউইচে কামড় বসাবার সাথে সাথে রাঙার মা’র অভাবটা অনুভব করল রানা ।

হলওয়েতে ফিরে এসে সদর দরজার সামনে থেকে চিঠিগুলো কুড়িয়ে নিল ও। এক হাতে চিঠি, অপর হাতে গ্লাস, লাউঞ্জে ঢুকে একটা আর্মচেয়ারে বসল । গ্লাস চুমুক দিল, কোল থেকে নিয়ে একটা একটা করে এনভেলাপ খুলল । পুরানো এক বান্ধবী লিখেছে, তার স্বামী জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে, বাধা, দিলে ডিভোর্স করার হুমকি দেয়, রানা কি এ-ব্যাপারে তাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে? লিলিয়ানের স্বামী অরওয়েল কোন ক্লাবে জুয়া খেলে জানে রানা, নোট বুকে লিখল- ‘দু’জন গুন্ডাকে কিছু পয়সা দিলে অরওয়েলকে তারা ক্লাবে ঢুকতে বাধা দেবে । তারপর অরওয়েলের সাথে একদিন বসব আমি ।’

সিকিউরিটি সংক্রান্ত ইকুইপমেন্ট-এর প্রদর্শনী হবে লন্ডনে, বিশেষজ্ঞরা লেকচারও দেবেন, অংশগ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রানাকে । সিদ্ধান্ত নিল; যাওয়া দরকার । বাকি চিঠিগুলো গুরুতৃপূর্ণ নয়, চোখ বুলিয়েই ফেলে দিল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ।

গ্লাস খালি করার পর বাথরূমে ঢুকল রানা । টনিক মেশানো ভোদকা, তারপর গরম পানিতে (গোসল, পেশীগুলোর আড়ষ্ট ভার দূর হয়ে গেল৷ আরামদায়ক ঘুম ভাব নিয়ে দিগম্বর সাজল রানা, বিছানায় ওঠার সাথে সাথেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে।

হাতুড়ি পেটানোর শব্দে জেগে উঠল রানা। চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে, তাকিয়ে আছে অন্ধকারে, ভাবছে এমন হঠাৎ করে তার ঘুম ভাঙল কেন? তারপর আবার হল শব্দটা । আওয়াজটা নিচতলা থেকে আসছে, সদর দরজা থেকে । টেবিল ক্লকের আলোকিত ডায়ালে চোখ পড়ল ওর, দুটো তেইশ মিনিট । এত রাতে কার আবার দরকার হল ওকে! তাছাড়া, কলিংবেল বাজাচ্ছে না কেন? পরমূহূর্তে নিজের ভুলটা ধরতে পারল রানা-নক করার শব্দ নয়, কেউ হাতুড়ি ঠুকছে। ঝট করে বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে পিস্তলটা ধরল ও, লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পর্দা সরিয়ে মুখটা কাচের সামনে আনলও, সরাসরি নিচেটা দেখার জন্যে । প্রায় সাথে সাথে হাতুড়ির শব্দ থেমে
গেল ।

অন্ধকারে দেখার জন্যে চোখ মিটমিট করল রানা । মনে হল নিচে একটা ছায়া মত কি যেন দেখতে পেয়েছে, তবে দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে । জানালার সামনে থেকে সরে এসে দ্রুত ট্রাউজার পরল রানা, সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নামতে শুরু করল । নামার সময় ভাবল, কি দেখলাম নিচে, কালো একটা ছায়ামুর্তি রাস্তা পেরিয়ে চার্চের উঠনে গিয়ে ঢুকল? নাকি অন্ধকারে চোখের ভুল?

ওর কোনও ইংরেজ বন্ধু, কৌতুক করার জন্যে গভীর রাতে দরজায় হাতুড়ি পিটছে? তা যদি হয়, ঘুসি মেরে শালার নাক চ্যাপ্টা করে দেবে সে। রেগে গেছে রানা । নিচে নেমে হলওয়েতে থমকে দাড়িয়ে পড়ল । কেন যেন ইতস্তত একটা ভাব এসে গেছে ওর মধ্যে । দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু খুলতে ইচ্ছে করছে না। পরিবেশটা কেমন যেন থমথম করছে, গা শিরশির করে উঠল । তারপর শব্দটা শুনতে পেল রানা-ভোতা, অস্পষ্ট যেন মুখের ভেতর পানি নিয়ে কুলি করছে কেউ।

হলওয়ে ধরে ধীরে ধীরে এগোল রানা, আটকে রেখেছে নিঃশ্বাস, সতর্ক পদক্ষেপ। দরজার পাশে থামল, মুখটা বাড়িয়ে কবাটে কান চেপে ধরল ।

কে যেন দরজার গা আচড়াচ্ছে। মনে হল কে যেন ফিসফিস করছে। আওয়াজটা মানুষের বলে মনে হল না, যেন ব্যথায় ফোপাচ্ছে কোনও পশু । পিস্তলটা শক্ত করে ধরে দরজার বোল্ট ধরতে যাবে রানা, ঠক করে কি যেন ঠোকার শব্দ হল দরজার গায়ে, চমকে এক পা পিছিয়ে এল রানা ।

হঠাৎ লজ্জা পেল ও, তিরস্কার করল নিজেকে । অন্ধকারে ভীতসন্ত্রস্ত বুড়ির মত দাড়িয়ে রয়েছে সে, দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে! বোল্ট ধরে টান দিল ও, এক ঝটকায় খুলে ফেলল কবাট।

দোরগোড়ায় হাত-পা ছড়িয়ে দাড়িয়ে রয়েছে একটা মূর্তি । হাত দুটো দরজার ফ্রেম ধরে আছে। মাথাটা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। গাঢ় তরল পদার্থ বেরিয়ে আসছে মূর্তির মুখ থেকে। অদ্ভুতভাবে নেতিয়ে রয়েছে সে, হাটু দুটো এমনভাবে ভাজ করা যেন শরীরের ভার বইছে না। কাতর, অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ করছে, মাঝে মধ্যে আওয়াজটা বেড়ে যাওয়ায় আহত পশুর ফোপানির মত শোনাচ্ছে; মনে হল গলার ভেতর আটকে যাওয়া পানি বা তরল কিছু কুলকুল শব্দ করছে।

নিস্তেজ শরীরটার পিছনে ঘন অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না রানা। হলওয়ের আলো জ্বালার জন্যে সুইচবোর্ডটা হাতড়াল ও । আলোর আকম্মিক বন্যায় ধাধিয়ে গেল চোখ। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝতে পারল, দোরগোড়ায় দাড়িয়ে থাকা মুর্তিটা কোনও পুরুষের নয়। স্লিপিং গাউন পরে আছে। ঝুলে পড়ায় মাথার শুধু
মাঝাখানটা দেখতে পেল রানা। আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ওর বুক, চেনা, চেনা লাগছে মাথাটা ।

‘তমা!’ অস্ফুট ডুকরে ওঠার মত শব্দ বেরুল রানার গলা থেকে । সামনে এগিয়ে তমার মাথাটা উচু করল ও। তমার মুখ থেকে গড়িয়ে নেমে আসা রক্তে ভিজে গেল ওর হাত । তমার চোখ ঘষা কাচের মত- কিনারায় লালচে রেখা, তবু
রানার মনে হল ওকে যেন চিনতে পেরেছে সে।

“তমা! কি হয়েছে তোমার?” পিস্তলটা কোমরে গুজে তমাকে দু’হাত দিয়ে ধরার জন্যে আরও সামনে এগোল রানা। কি কারণে বোঝা গেল না তমার হাত দুটো আগের মতই দরজার ফ্রেম ধরে থাকল, যেন চৌকাঠ থেকে নামাবার ইচ্ছে নেই। মাথাটা এ-পাশ ও-পাশ করল একবার, কথা বলার চেষ্টা করল । গলার ভেতর রক্ত থাকায় কোনও শব্দই বেরুল না।
“ওহ খোদা! তমা, কে তোমাকে”? দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তমাকে নিজের বুকের দিকে টানল রানা, কাধে তুলে লাউঞ্জের সোফায় নিয়ে যেতে চাইছে। দুর্বল একটা চিৎকার বেরিয়ে এল তমার মুখ থেকে । গায়ের লোম দাড়িয়ে গেল রানার । একি রকম আওয়াজ?
“তমা, চৌকাঠ ছাড়! তোমাকে ভেতরে নিয়ে আসি!’ ব্যাকুল গলায় বলল রানা ।
আবার কথা বলার চেষ্টা করল তমা, জ্ঞান হারাবার সাথে সাথে সামনের দিকে ঝুলে পড়ল মাথা। এবার আরও একটু জোরে টানল তাকে রানা কিন্তু এখনও চৌকাঠ আকড়ে ধরে আছে সে। তারপর লক্ষ্য করল রানা, হাত বেয়ে নেমে
আসছে রক্তের কয়েকটা ধারা । তমার, কাধের ওপর দিয়ে মুখটা সামনে বাড়াল ও, সাথে সাথে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ । তমার হাতের উল্টোপিঠে পেরেক দেখতে পেল ও।


একহাতে তমার কোমর জড়িয়ে ধরে শরীরটাকে সামান্য উচু করল রানা, দেখল তার অপর হাতেও পেরেক গাথা রয়েছে । “তমা! তমা! বিড়বিড় করছে রানা, নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে আছে মেয়েটাকে, উচু করে রেখেছে যাতে
চৌকাঠে গাথা হাত দুটো ছিড়ে না যায়। “হেল্প প্লীজ হেলপ!’ চিৎকার করল ও, আশা-প্রতিবেশীরা কেউ শুনতে পাবে । আশপাশের কোনও বাড়ির জানালা আলোকিত হল না। গভীর রাত, সবাই ঘুমোচ্ছে, নয়তো ঝামেলা মনে করে সাড়া
দিচ্ছে না। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিল রানা, বুঝতে পারছে নষ্ট করার মত সময় নেই। অনেকক্ষণ ধসে চিৎকার করলে এক সময় কেউ না কেউ আসবেই, কিন্ত ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

যতোটা সম্ভব আলতোভাবে তমার শরীরটা ছেড়ে দিল রানা, এক ছুটে কিচেনে এসে ঢুকল। কাবার্ড খুলে টুলবক্স থেকে একটা হাতুড়ি নিয়ে ফিরে এল তখুনি, বুকের ভেতর তড়পাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে শরীর । তমার ছেঁড়া স্লীপিং গাউন রক্তে ভেসে যাচ্ছে, বেশিরভাগ রক্ত মনে হল মুখ থেকেই বেরিয়েছে । তমার বগলের নিচে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল রানা, এক হাতে অজ্ঞান দেহটাকে ধরল, অপর হাতে হাতুড়ির চেরা দিকটা ঢুকিয়ে দিল পেরেকের মাথার নিচে । তমার হাতের উল্টোপিঠে হাতুড়ি না ঠেকিয়ে পেরেকটা উপড়ে আনার চেষ্টা করল ও। অসম্ভব বলে মনে হল, চৌকাঠের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে রয়েছে পেরেকটা। ধারণা করল অন্তত চার ইঞ্চি লম্বা হবে ওটা । অগত্যা বাধ্য হয়ে তমাকে ছেড়ে দিতে হল, হাতুড়িটা দু’হাত দিয়ে ধরে উপড়ে আনার চেষ্টা করল পেরেকটাকে ৷ আবার নেতিয়ে পড়ল তমার শরীর। দু’হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাতুড়িটা নিজের দিকে টানল রানা। রক্তাক্ত পেরেক বেরিয়ে আসার সাথে সাথে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ওর গলা থেকে । তমা একপাশে কাত হয়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল ও, তা না হলে অপর হাতটা চৌকাঠে গাথা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে যেত সে। তমার পেটের নিচে ভাজ করা একটা হাটু ঠেক দিয়ে রাখল ও, তারপর আবার সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্বিতীয় পেরেকটাকে উপড়ে আনার চেষ্টা করল । একদিকে কাত হয়ে আছে পেরেক, হাতুড়ির চেরা অংশটা পেরেকের মাথার নিচে ঢোকাবার সময় তমার হাতের চামড়া ছিড়ে গেল। ভয়ানক খারাপ লাগল রানার, কিন্তু জানে এছাড়া কোনও উপায় নেই-যতোটা সম্ভব তাড়াতাড়ি মুক্ত করতে হবে ওকে।

চার ইঞ্চি লম্বা পেরেক টিল হল, তারপর বেরিয়ে এল, রাস্তার ওপর পড়ে টিং- টিং শব্দ করল দু’বার । হাতুড়ি ফেলে অজ্ঞান দেহটাকে কাধে তুলল রানা, লাউঞ্জে ঢুকে ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল সোফায় । আলো জ্বালল, “হাটু গেড়ে বসল তমার পাশে, ভাবছে এ্যাম্বুলেন্স ডাকার আগে ওর কিছু করার আছে কিনা । মাথাটা নিষ্প্রাণ জড় বস্তুর মত একপাশে কাত হল, খোলা চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না তমা। আশঙ্কা ও আবেগে বিড়বিড় করল রানা, যেন তমার নাম ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ওর পেশাজীবনে তমার মত এত লাজুক ও নিঙ্কলুষ মেয়ে দ্বিতীয়টি দেখেনি ও। লন্ডনে তমার কোনও অভিভাবক নেই । তার জন্যে সুদর্শন একটি পাত্র বেছে রেখেছে ও। সেই তমার, ওর প্রিয় সহকারিণীর, এই অবস্থা হল কি করে? গলায় কান্না উঠে এল। নিজেকে ‘অনেক কষ্টে দমন করে ব্যস্ত হাতে স্লীপিং গাউন ছিড়ে ফেলল রানা, হুক খুলে বুক থেকে ব্রেসিয়ার সরাল, হাত রাখল তমার হৃৎপিণ্ডের ওপর । হাতটা কাপছে, কিছুই অনুভব করল না। কাজেই তমার বুকের ওপর একটা কান চেপে ধরল । হার্টবিটের কোনও শব্দ পাওয়া গেল না। ,

মাথাটা দু’হাতে ধরে “তমা তমা” করে চিৎকার করল রানা’। স্থির মুখের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে থাকিয়ে বিড়বিড় করল, বেঁচে থাক, ভাই। খোদার দোহাই, মরিস না। তমার মুখ হা হয়ে আছে। রানা দেখল, ভেতরে ঘন হয়ে রয়েছে রক্ত। সম্ভবত মুখ ও গলায় রক্ত জমে থাকায় শ্বাস ফেলতে পারছে না, এ-কথা ভেবে শরীরটাকে উপুড় করতে গেল রানা । পরমুহূর্তে, মুখের ভেতর ভাল করে তাকাতেই, শক্ত পাথর হয়ে গেল ওর পেশী । মুখের ভেতরটা বিশাল একটা গর্তের মত, সেখানে রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই। রানার পেটের ভেতরটা অকম্মাৎ মোচড় দিয়ে উঠল । নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে তমার মাথাটা ধীরে ধীরে সোফার ওপর নামিয়ে রাখল ও।

বুঝতে পারল, মারা গেছে তমা । কিন্তু বুঝল না, তার জিভটা কেন ছিড়ে নেয়া হয়েছে।

তিন

রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি, লন্ডন শাখায় গত সোমবার কি ঘটেছিল?

রিজেন্ট পার্কের কাছাকাছি, নতুন শাখা অফিসে আসছে মাসুদ রানা । সকাল দশটা, ………

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top