একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
রিকশা থেকে নেমে সুই সুক থ্রী-তে ঢুকে পড়ল মাসুদ রানা। সরু রাস্তা, দু’পাশে গায়ে গায়ে লেখে থাকা আলো ঝলমলে দোকানপাট । সন্ধে নামছে, মাথার ওপর লম্বা একফালি বিবর্ণ আকাশ। |
জুয়েলারির দোকানটা ছোট কিন্তু পরিপাটি করে সাজানো । ভেতরে ঢুকেই দু’ধরনের আওয়াজ পেল রানা। ওপর তলার কোথাও, গিটার বাজাচ্ছে কেউ । দোকানের ঠিক পিছন থেকে আসছে ঠুক ঠাক ঠোকাঠুকির শব্দ । তার মানে কারখানা আর বাসাবাড়ি নিয়ে দোকান। কাউন্টারের ওদিকে ওঅর্ক- বেঞ্চে বসে সোনার আংটিতে একটা ওপ্যাল পাথর বসাচ্ছে থুথুড়ে এক বুড়ো । দোকানে আর কাউকে দেখা গেল না।
“আসসালামোআলেকুম!’
হুড পরানো ল্যাম্পের আলোয় ঝিক করে উঠল ওপ্যাল; ভুরু কুঁচকে মুখ তুলল বুড়ো। ‘ওয়ালেকুমসালাম।’
মি. লিয়েন মনতাজ? জিজ্ঞেস করল রানা।
কালো মখমলের ওপর আংটি রেখে রানার সাথে করমর্দন করল বুড়ো। চোখ যেন একজোড়া সার্চলাইট, রানার চেহারা ও কাপড়চোপড় খুটিয়ে দেখে নিল। অ্যাশ কালারের কোট পরেছে রানা লাল টাই, পায়ে চকচকে কালো জুতো । মৃদু একটু হেসে মাথা ঝাকাল বুড়ো, যেন এই পোশাক পরা একজন লোককেই আশা করেছিল সে। ইয়েস
‘আমার একটা অর্ডার ছিল, বলল রানা।
ইয়েস?
সাংকেতিক শব্দটা ব্যবহার করল রানা, ব্লাডস্টোন।’
সমীহের সাথে মাথা নিচু করে বাউ করল বুড়ো মনতাজ, রানাকে পাশ কাটিয়ে এগোল খোলা দরজার দিকে । দোরগোড়ায় দাড়িয়ে উকি দিল বাইরে, ডানে বায়ে তাকাল। তারপর ফিরে এসে বলল, ‘কারিগরের একটা হাত নেই
কিনা, খুব ঢিমে তালে কাজ করে, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আসুন।’
মনতাজের পিছু পিছু দোকানের পিছনে সরু একটা প্যাসেজে চলে এল রানা। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে ও। ছিল প্যারিসে, বি.সিআই. হেডকোয়ার্টার ঢাকা থেকে চীফ অ্যাডমিনিসট্রেটর সোহেল আহমেদের মেসেজ পেয়ে সাত তাড়াতাড়ি ব্যাংককে চলে এসেছে। জরুরী তলবের কারণ হিসেবে মেসেজে কিছু বলা হয়নি। এই জুয়েলারি দোকানের ঠিকানা, মালিকের চেহারার বর্ণনা আর একটা সাংকেতিক শব্দ জানানো হয়েছে ওকে। উত্তরে লোকটার বলার কথা, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে’ কারিগরের একটা হাত নেই…’ এধরনের কিছু বলার কথা ছিল না । কথাটার
নিশ্চয় কোন তাৎপর্য আছে। সোহেলের একটা হাত নেই…তাহলে কি সে নিজেই ওর সাথে কথা বলার জন্যে ব্যাংককে আসছে? তা যদি হয়, ব্যাপার অত্যন্ত গুরুতর না হয়েই যায় না । বিশেষ জরুরী কিছু ঘটলেই শুধু দেশের বাইরে পা দেয় চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ।
বিপ্জ্জানক একটা অ্যাসাইনমেন্টের আশায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল রানা । একটা সিড়ির পাশ ঘেঁসে এগোল ওরা । গিটারের আওয়াজ স্পস্ট হয়ে উঠল । বুড়ো মনতাজের পিছু পিছু খোলা একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা।
ঘরের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে কেবিনেট আর সেফ, কোন রকমে ঠাই করে নিয়েছে একটা ছোট টেবিল আর একটা চেয়ার। দেয়ালগুলো পাতলা কাঠ গিয়ে মোড়া। টিউব লাইটের প্রায় সব টুকু আলো গিয়ে পড়েছে রোজ-উড দিয়ে তৈরি একটা বুদ্ধ মুর্তির উপর।
রানার দিকে ফিরে আবার একবার মাথা নিচু করে বাউ করল বুড়ো মনতাজ। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ হতেই চারদিকে আরেকবার চোখ বুলাল রানা । তিনটে জিনিশ বিশেষভাবে লক্ষ করল ও। ঘরে একটা টেলিফোন আছে। মুর্তির পাশেই আরেকটা দরজা, এবং কামরার একমাত্র জানালা | এই দ্বিতীয় দরজা দিয়ে সরাসরি রাস্তায় বেরোনো যায়। বাড়ির সামনের অংশ থেকে এই ঘর অনেকটা দূরে হলেও, কারখানার টুকটাক আওয়াজ একান থেকেও পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়।
অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে রানা, ক্লান্ত। কি কাজে ডাকা হয়েছে জানে না, তাই কিছুটা উদ্বিগ্নও । টের পাবার আগেই একটা গুলি ছুটে এসে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিক, তা চায় না ও | চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দেয়ার চিন্তাটা বাতিল করে দিল; দরজার দিকে কান আর জানালার দিকে একটা চোখ রেখে ডিসপ্লে কেসগুলোর সামনে দাড়াল ও । গাঢ় নীল রঙের ল্যাপিস লাজিউলি, রোজ কোয়ার্টজ, অবসিডিইয়ান, মুনস্টোন, হরেক হরেক রকম হীরে আর মুক্তো । জায়গাটা স্রেফ একটা ফ্রন্ট নয়, সত্যিকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হলো রানাকে। বুদ্ধ মুর্তির পাশের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে । গম্ভীর চেহারা । বাম হাতটা ট্রাউজারের পকেটে । কোটের বাটন হোলে লাল একটা গোলাপ । দরজা বন্ধ করে রানার দিকে ফিরল সোহেল আহমেদ। ‘কখন পৌছেছিস’ খালি চেয়ারটায় বসে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ড্রাম বাজাতে শুরু করল হাতলে।
‘কোথায়?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রানা। ‘এখানে, না ব্যাংককে?’
থাইল্যান্ডে।
হাতঘড়িটা দেখল রানা | ঘন্টাখানেক আগে । টেবিলের উপর বসল ও। “কি এমন ব্যাপার যে তোকেই আসতে হলো?
কোটের সাইড পকেট খেকে স্টেট এক্সপ্রেসের প্যাকেট আর লাইটার বের করল সোহেল। রানার প্রশ্ন এড়িয়ে জানতে চাইল, ‘প্যারিসে যে কাজটি করছিলি সেটার খবর কি?
রানাও প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। বলল, “আমার যত দূর মনে পড়ে তোর একটা হাত ছিল লা । সেটা আবার গজাল কিভাবে?
আর্টিফিশিয়াল।
মুচকি একটু হাসল রানা । “তোর গম্ভীর গম্ভীর ভাবটুকুর মতই। তাই না?
গম্ভীর! কই, না! যদিও সোহেলের চেহেরায় গাম্ভীর্যের মুখোশ অটুটই রইল। সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেট আর লাইটারটা টেবিলের ঠেলে দিল রানার দিকে। ‘নে, খা ।’ জানে। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে রানা। কে কার সিগারেট ধ্বংস করবে তাই নিয়ে একসময় মারপিট লেগে যেত ওদের মধ্যে।
শান্তভাবে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল রানা | তাই দেখে বিস্ময় ও সতর্কতার ভাব ফুটল সোহেলের চেহারায়। সিগারেটের প্যাকেট খুলে রানা ভেতরে থাকাল দেখে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল সে, খাবি নাকি রে?
“আরে না।’ হাসল রানা । প্যাকেটের ভেতর থেকে দৃষ্টি তুলল । মাত্র তিনটা খেয়েছিস দেখছি ।।
রানা খাবে না শুনে ভয় মুক্ত হলো সোহেল। গম্ভীর সুরে কাজের কথা পাড়ল সে। “প্যারিস আসাইনমেন্টের রিপোট পরে দিলেও চলবে…
জিনিসটা কিন্তু বিষ, সোহেলকে বাধা দিয়ে বলল রানা । ‘খাওয়া উচিত নয়।”
চটে উ্ঠল সোহেল। আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না…
‘কে বলল আমি তোর স্বাস্থ্য সম্পর্কে মাথা ঘামাচ্ছি?’ জানতে চাইল রানা। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভাবছি আমি ।’
“মানে?
“মানে সিগারেটের ধোঁয়া মাত্রই ক্ষতিকর” বলল রানা । প্যাকেটটা বন্ধ করল ও | “এই যে তুই খাচ্ছিস, তাতে আমারও ক্ষতি হচ্ছে কথাটা মানিস?
আবার সতর্ক ভাব ফুটল সোহেলের চেহারায়। দেখো, শ্যালক, আমরা এখানে একটা কাজের কথা আলোচনা করতে বসেছি। স্বাস্থ্য সম্পর্কে লেকচার তোর কাছ থেকে নয়, পাস করা একজন ডাক্তারের কাছ থেকেই শুনতে পছন্দ করি আমি। দে । হাত বাড়াল সে।
প্যাকেটটা নিজের সামনে টেবিলের উপর রাখল রানা । সিগারেটের ধোঁয়া ক্ষতিকর এটা বুঝতে ডাক্তারের লেকচার লাগে না। কথাটা তুই স্বীকার করিস কিনা, আমি শুধু এটুকু জানতে চাই ।’
“ঠিক আছে, মানলাম– ক্ষতি করে…
সিগারেটের প্যাকেটের উপর দুম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল রানা।
স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সোহেল। এক ঘুসিতেই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে প্যাকেট, ভেতরে একটা সিগারেটও যে অক্ষত নেই তা আর বলে দিতে হয় না । দুর্বোধ্য হাহাকার ধ্বনি বেরিয়ে এল তার গলা থেকে।
খাই না জেনেও অফার করেছিস, আত্নতৃপ্তির হাসি দেখা গেল রানার মুখে, তাই একটু খেসারত দিলি আর কি!
আমার সাড়ে বত্রিশ টাকা ধবংস করেছিস, দাঁতে দাঁত চেপে বলল সোহেল। আমার নাম যদি সোহেল হয় মনে রাখিস, এই টাকা আমি আদায় করে ছাড়ব।
কাজের কথা হোক |” প্রস্তাব করল রানা, মিটি মিটি হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে । লিয়েন মনতাজ কে?
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।